|| মো. তোফাজ্জল বিন আমীন || মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের পিতা আযর মূর্র্তিপূজারী ছিলেন। সন্তান হিসেবে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মূর্র্তিপূজার অনুসারী ছিলেন না। মূর্র্তি পূজার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তাকে আগুনে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) পবিত্র কাবাঘর থেকে লাত, মানাত, উজ্জাসহ ৩৬০টি মূর্র্তি অপসারণ করে সেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুনিয়ার সকল আম্বিয়ায়ে কেরামগণ মূর্র্তি পূজা ধ্বংস করার জন্যে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্ত আজকে একশ্রেণীর মুসলমানরা মূর্তি পূজা বা ভার্স্কষ অপসারণে মায়াকান্না করছে। ভাস্কর্যটি অপসারণ করায় মহান আরশের মালিকের কাছে লাখো কোটি শুকরিয়াও জ্ঞাপন করেছিলাম এই ভেবে যে দেরিতে হলেও গ্রীক দেবীমূর্তিটি অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু ৪৮ ঘন্টা পেরুতে না পেরুতে রাম আর বামদের খপ্পরে আবারো গ্রিক দেবীর ভাস্কর্যটি সুপ্রিমকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে। কার ইশারায় বা কার স্বার্থে এটি করা হয়েছে তা জাতির সামনে উন্মোচন করা হোক। সরকার ভাস্কর্যটি নিয়ে ইঁদুর বিড়াল খেলা খেলেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতার কথা বিবেচনা না করে খুচরা বুদ্ধিজীবীদের কথায় ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপন করে আবারো মুসলমানদেরকে চপটেগাত করা হলো।
রোজা শুরুর মাত্র দুদিন আগে নাটকীয় পরিবেশের মধ্যদিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি অপসারণ করার ৪৮ ঘন্টায় মধ্যে আবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেই বসানো হয়েছে। তবে একটু সরিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বর্ধিত এনেক্স ভবনের সামনে। প্রায় ৩০ জন শ্রমিক ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনের কাজ করছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ভাস্কর মৃণাল হক। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে সুপ্রিমকোর্টের ফটকে উপস্থিত সাংবাদিকদের ভাস্কর মৃণাল হক বলেন, এখানে বসানো না বসানো সমান কথা। কারণ এখানে এটিকে কে দেখবে? কাদের নির্দেশে এনেক্স ভবনের সামনে ভাস্কর্য বসানো হয়েছে এমন প্রশ্নে মৃণাল হক বলেন, সুপ্রিমকোর্ট অথরিটির নির্দেশে এখানে বসানো হয়েছে। ভাস্কর্যটিকে প্রতিস্থাপন করা প্রসঙ্গে তার অনুভূতির বিষয়ে জানতে চাইলে মৃণাল হক বলেন, একটা মানুষ মারা গেলে তাকে কবরে দিয়ে এলে যে অনুভূতি হয়, আমারও সেই অনুভূতি হচ্ছে। এই মৃণাল হক ভাস্কর্য অপসারণ করার সময় বলেছেন তার মা মারা যাওয়ার পরও এতো কান্না সে কাঁদেনি। অথচ একশ্রেণীর খুচরা বুদ্ধিজীবীরা বলছেন ভাস্কর্য তো পূজা করার জন্য তৈরি করা হয়নি। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম পূজা করার জন্য ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়নি তাহলে ভাস্কর মৃণালের গায়ে এতো জ্বালা কেন? মুসলমানদের ঈমান আকিদার উপর কেউ কালিমা লেপন করলেও খুচরা বুদ্ধিজীবীরা একটু টুশব্দ পর্যন্ত করে না। এমনকি তসলিমা নাসরিনের মতো লেখকরা যখন ইসলামের বিপক্ষে কলাম লেখেন তখনও তারা নিশ্চুপ থাকেন। অথচ ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্যের পরিপন্থী ভাস্কর্য অপসারণ করার কথা বললে তাদের মায়া কান্না হয়। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ইসলামের ইতিহাস একটু অধ্যায়ন করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। আবু জেহেল যেমন স্বচক্ষে আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)কে দেখার পরও ঈমান আনতে পারেনি। তেমনি খুচরা বামরাও জেনে বুঝে ইসলামের বিরোধীতা করছে। একটা উদাহারণ দিলে পাঠকেরা সহজে বুঝতে পারবেন। নিকট অতীতে ইসলামী দলগুলো পুলিশের কাছে অনুমতি চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টপানে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যেতে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানববন্ধন করতে। কিন্তু জাতীয় সংবেদনশীল জায়গা হওয়ায় ধর্মপ্রাণ তওহিদী জনতা কোনো কঠিন আন্দোলন বা নিয়ম ভেঙে বিক্ষোভ করেনি। অথচ মূর্র্তি অপসারণের পর হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ প্রতিবাদ করেছে। যারা দুইদিন ধরে প্রতিবাদ করেছে তাদের ছবি এবং নাম পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে। তারা সকলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরসূরী। এরা ছাত্র ইউনিয়ন, সিপিবির রাজনীতির সাথে জড়িত। হাতে গোনা ১৫-২০ জন নেতা কর্মী কমিউনিস্ট এর ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদ করার সুযোগ পায়। কিন্তু ইসলামী দলগুলো তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য মিছিল করা তো দূরের কথা মানবন্ধনের সুযোগটুকু পায় না। এ থেকেই কী প্রমাণিত হয় না বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করছে না। সরকার বামপন্থীদের সুযোগ দেয় বলেই তো হাসান ইমাম আর রামেন্দ্র মজুমদারের মতো ব্যক্তিরা ইসলামের বিপক্ষে দরাজ কন্ঠে আওয়াজ তুলছে। সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে এই ধরনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রতিবন্ধীরাও করতে পারে। শাহাবাগীদের আন্দোল আস্ফালনের কথা নিশ্চয় পাঠকেরা ভুলে যায়নি। সরকার একবার জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দলকে মাঠে নামতে দিক, দেখা যাবে কার সমর্থন এবং শক্তি কত? যদি জামায়াতকে বাধা দেয়া না হয় তাহলে মূর্র্তি অপসারণের দাবির সপক্ষে লাখো তওহিদী জনতার নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনি ইথারে ইথারে ভেসে উঠবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রগতিশীলের নামে তারা যা করবে, তাই ঠিক। মজলুম মুসলমান ও ধর্মপ্রাণ মানুষের বুকে রক্তক্ষরণও এ দেশে মস্তবড় অপরাধ। তাদের অহিংস আন্দোলন কিংবা মানববন্ধনের মতো প্রতিবাদ করাটাও যেন অপরাধ আর প্রগতিশীল নাম ধারণ করে যা ইচ্ছে তা-ই করা হোক না কেন তা সবই জায়েজ। এই নোংরা সংস্কৃতির রাজনীতি পরিহার করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন কখনও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সামনে গ্রিক দেবীর মূর্র্তি স্থাপন বাংলাদেশের গণমানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আদর্শিক চেতনার বিপরীত। গত ১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে কওমি মাদরাসার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের এক সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের সামনে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিত নয়। আমি আপনাদের বলব, আপনারা ধৈর্য ধরেন। এটা নিয়ে কোনো হৈচৈ নয়। একটা কিছু যখন করে ফেলেছে, সেটাকে আমাদের সরাতে হবে। সেটার জন্য আপনারা এতটুকু ভরসা অন্তত রাখবেন যে, এ বিষয়ে যা যা করার আমি তা করবো। ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে যুক্তি হিসেবে এর নান্দনিক ত্রুটির পাশাপাশি জাতীয় ঈদগাহের কাছে অবস্থানের কথা বলেন তিনি। বিতর্কিত মূর্র্তিটি সরানোর পর দেশের আলেম সমাজ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছিল করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রধানমন্ত্রী আলেম সমাজের কাছে দেয়া ওয়াদা রাখতে পারলেন না। কাকে খুশি করার জন্যে তিনি ওয়াদার বরখেলাপ করলেন আল্লাহ মালুম। এক শ্রেণীর মানুষেরা মনে করেন ওই মূর্র্তির ভিতরেই রয়েছে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা সৌহাদ্য-সম্প্রীতি তথা ১৬ কোটি মানুষের আশা আকাংখা। তাদের কেউ কেউ আবার মূর্র্তি সরানোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত বলে প্রচার করেন। অথচ এদেশের নিরীহ মজলুম মানুষের উপর যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতন করা হয় তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলন্ঠিত হয় না। পাঁচ বছরের শিশুকে যখন ধর্ষণ করা হয় তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাদীর মুখ বা কলম থেকে টুশব্দ উচ্চারিত হয় না। ঐসব দলকানা বুদ্ধিজীবিদের নিকট থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা শিখার প্রয়োজন নেই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল মূলত সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে তারা এদেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে সমাজের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষের বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপন করে মুসলিম জাতিসত্ত্বার সাথে তামাশা করেছে। এই মূর্র্তি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্থাপিত হয়েছে। সুতারাং বাংলাদেশের কোথাও স্থান দেয়া উচিত হয়নি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে থেমিসের মূর্র্তি পুনঃস্থাপন করার মধ্যদিয়ে আবারো লীগ সরকার প্রমাণ করলো তারা ইসলাম এবং মুসলমানদের বন্ধু হিসেবে শ্রদ্ধাবোধ দেখাতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভাস্কর মৃণাল হকের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন। কে এই মৃণাল হক, যাকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে মূর্র্তি তৈরি করানো হচ্ছে? কে করাচ্ছে? কেন করাচ্ছে? মূর্র্তি তৈরির জন্য কেন তাকে বেছে নিলো? কি তার উৎস এবং উদ্দেশ্য এই বিষয়টি জাতির সামনে পরিষ্কার করা দরকার। আমরা মনে করি ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে মৃণাল হকরা আওয়ামী সরকারকে ডুবানোর রাস্তাকে প্রশস্ত করে দিচ্ছে। সময় কারো চিরদিন সমান নাহি যায়। এটা ক্ষমতাসীনরা এখন অনুধান করতে পারবে না। কারণ ক্ষমতার মোহে কালো চশমাও রঙিন হয়ে উঠে।
ধর্মনিরেপক্ষতার ধ্বজাধারী বোদ্ধারা মনে করেন গ্রীক দেবী মানব জাতিকে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতা পালনের নির্দেশ প্রদান করে। তার মুখনিঃসৃত বাণী স্বর্গীয় আইন হিসেবে বিবেচিত। ওইসব প-িত নামের চেতনাবাদীর নিকট প্রশ্ন হলো, থেমিস বাংলাদেশের বিচারের প্রতীক হবে কেন? ন্যায়বিচারের জন্যে গ্রীক মূর্র্তির ভাস্কর্য স্থাপন করার কোনো মানে হয় না। কেউ যদি ভাস্কর্য বানাতে চায় তা নিজের বাসায় অথবা অধিকারভুক্ত স্থানে তা স্থাপন করলে কেউ আপত্তি করবে না। ন্যায়বিচার যদি গ্রীক দেবীর মূর্র্তি নিশ্চিত করতে পারতো তাহলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদতো না। গ্রীক মূর্র্তি স্থাপন করার আগে কি সুপ্রিম কোর্টে ন্যায়বিচার হয়নি? সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ন্যায়বিচারের সর্বস্বীকৃত প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা সুপ্রিম কোর্টে শোভা পাচ্ছে। ৯২ শতাংশ মুসলমানের বিশ্বাস, চিন্তা ও ঐতিহ্যে মূর্র্তির কোনো স্থান নেই। এদেশের হাজারো মানুষ জানতে চায় কার স্বার্থে কল্পিত মূর্র্তি সুপ্রিম কোর্টের ভেতরেই পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।