৩১ মে ২০১৭, বুধবার, ১১:১৪

অস্থিরতা বাড়ছেই চালের বাজারে

ভিয়েতনাম থেকে আসছে প্রতিনিধি দল * মজুদ নিয়ে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই -খাদ্যমন্ত্রী

ভরা মৌসুমে ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের বাজার দর নিয়ে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না চালের বাজার। সরকারি তরফ থেকে এ অস্থিরতা অস্বীকার করা হলেও এক সপ্তাহেই মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি এক টাকা। চুক্তির সময় বাড়িয়েও মিলারদের কাছ থেকে সন্তোষজনক সাড়া না পাওয়ায় এ অস্থিরতা আরও বাড়ছে। এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৮০০ মিলার চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১৬ হাজারেরও বেশি।


এ পরিস্থিতির জন্য গণমাধ্যম ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলাম। তার মতে, দেশে পর্যাপ্ত ধান চাল রয়েছে। মিডিয়ায় নেতিবাচক প্রচারণা ও অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চালের বাজার অস্থির করে তুলেছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, মাঝারি ও মোটা চালের পাইকারি ও খুচরা উভয় মূল্যই বেড়েছে। গুটি ও স্বর্ণার মতো মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৬ টাকা দরে। অথচ এক সপ্তাহ আগে এসব চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা। এদিকে সরকারের মজুদের অবস্থাও দিন দিনই নাজুক হচ্ছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারের মজুদ ছিল ৪ লাখ ৯৮ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ২ লাখ ২৪ হাজার টন এবং গম ২ লাখ ৭৪ হাজার টন। অথচ গত বছর একই সময়ে এ মজুদ ছিল ৯ লাখ ২৭ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ৫ লাখ ৯৪ হাজার টন এবং গম ছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার টন। এর বাইরে বন্দরে আরও ৭ হাজার টন খাদ্যশস্য খালাসের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

সাধারণত সরকারের ভাণ্ডারে গমের চেয়ে চালের মজুদ বেশি থাকে। এবার পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে চালের চেয়ে গমের মজুদ বেশি।

এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলাম সোমবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, মিডিয়া তিলকে তাল করে প্রচার করার কারণে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্ক দেখা দিয়েছে জনমনে। এখন (সোমবার) পর্যন্ত ১ লাখ ৬৫ হাজার টন বোরো চাল সরবরাহের চুক্তি হয়েছে। এরই মধ্যে এক লাখ টন আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বানও করা হয়েছে। সরকার থেকে সরকার (জি টু জি) পর্যায়ে চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে এখনও যে চালের মজুদ রয়েছে তাতে আগামী দুই মাসে কোনো ধরনের সংকট হবে না।

২ মে থেকে সারা দেশে বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল সংগ্রহের এ অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ১ হাজার ২০৯ টন সিদ্ধ ও আতপ চাল। খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্ত ৪ হাজার ৮০০ মিল মালিকের সঙ্গে ১ লাখ ৬৫ হাজার টন বোরো চাল সরবরাহের চুক্তি হয়েছে। আজ পর্যন্ত মিল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা যাবে। সাধারণত প্রতি বছর ১৬ থেকে ২০ হাজার মিল মালিক সরকারের সঙ্গে চাল সরবরাহের চুক্তি করে থাকেন। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করার অনীহার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালকল মালিক যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান বাজারে মোটা চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা দরে। আর সরকার চালের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা। সরকারি দামে কোথাও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষক ওই দামে আমাদের চাল দিচ্ছে না। ফলে আমরাও সরকারকে ওই দামে চাল দিতে পারছি না। বাজারে এক কেজি ধান কিনে তা মিলে ভাঙিয়ে চালে পরিণত করতে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা খরচ পড়ে। তাহলে আমরা কীভাবে সরকারি গুদামে ৩৪ টাকা কেজিতে চাল দেব। এ কারণে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আমরা আপিল করেছি।

সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বোরো চালের দাম পুনঃনির্ধারণ করার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, বোরোর দাম বাড়ালে বাজারেও এর প্রভাব পড়বে। চালের দাম আরও বাড়বে। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই এ মুহূর্তে চালের দাম বাড়ানোর কোনো চিন্তাভাবনা সরকারের নেই। চালের বাজারে চলমান অস্থিরতা দূর করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত সপ্তাহে অনির্ধারিত সফরে ভিয়েতনাম যান খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। সেখানকার সরকারের সঙ্গে জি-টু-জি পদ্ধতিতে চাল আমদানির বিষয়ে আলোচনা সেরে দেশে ফিরেছেন তিনি। ৩ জুন ভিয়েতনামের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসতে পারে। প্রতিনিধি দল তাদের চালের নমুনাও সঙ্গে আনবে। নমুনা দেখার পর চালের দর-দাম নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ভিয়েতনাম থেকে জি-টু-জি পদ্ধতিতে চাল আনবে সরকার। তবে এ চাল আমদানিতেও দীর্ঘ সময় লাগবে।

বিদেশ থেকে জি-টু-জি পদ্ধতি এবং টেন্ডারে চাল আমদানি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সরকারের মজুদ তলানিতে নেমে যাবে কিনা জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এখনও আমাদের যে মজুদ আছে তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করবই। হাওরের ক্ষতি, অতিবৃষ্টি ও ব্লাস্ট রোগের কারণে সারা দেশে বোরো ক্ষতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ১২ লাখ টন হতে পারে। আর বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৯১ লাখ টন। এ থেকে ১২ লাখ টন নষ্ট হলেও বাকি ধান তো থাকছেই। যারা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়াচ্ছে। এদিকে ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচিতে এখনও চাল দেয়া হচ্ছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত ভিজিএফ কর্মসূচিতে গম দেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গণমাধ্যমে যা লেখা হয়েছে, তা অতিরঞ্জিত। তাদের কারণেই আজ চালের বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে মনস্ততাত্ত্বিক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে অসাধু কিছু চাল ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে। এতে জনগণের কোনো লাভ হচ্ছে না।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/31/128752/