৩১ মে ২০১৭, বুধবার, ১১:০২

সুপার সাইক্লোন ‘মোরা’র আঘাতে লণ্ডভণ্ড উপকূল

ঘূর্ণিঝড় মোরা চট্টগ্রাম অতিক্রমকালে সাগর ছিল উত্তাল। পতেঙ্গা এলাকায় অনেক কাঁচাঘর এ সময় বিধ্বস্ত হয়

* নারী-শিশুসহ ৬ প্রাণহানি * ২০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত
সুপার সাইক্লোন ‘মোরা’র আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দেশের উপকূলীয় জনপদ। কক্সবাজার, ভোলার মনপুরা ও রাঙামাটিতে প্রাণহানি ঘটেছে নারী ও শিশুসহ ৬ জনের। প্রচ- শক্তিশালী এ ঘূর্ণিঝড়ে মহেশখালীর শাহপরীর দ্বীপসহ বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া কক্সবাজারসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে প্রায় ২০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে প্রচুরসংখ্যক গাছপালা। ভেঙ্গে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার। কৃষি ফসলেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের ‘মোরা’ বাংলাদেশ সীমানা অতিক্রম করলেও শংকা-আতংকের পর ধ্বংসচিহ্ন রেখে যায় উপকূলীয় জনপদে। এর আগে ভোরে উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগে এসে কমতে শুরু করে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র শক্তি। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির চিত্রও স্পষ্ট হতে শুরু করে।
সচিবালয়ে এক জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝড়ে প্রায় ২০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার থেকে ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা নগদ সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সেন্টমার্টিনে নৌবাহিনীর একটি জাহাজ ত্রাণ নিয়ে রওনা হয়েছে। ত্রাণ সরবরাহে বিমান ও অন্যান্য বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আগে থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়ার কারণে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলেছে, ভাটার সময় ‘মোরা’ আঘাত হানায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। একই সাথে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঘূুির্ণঝড়টি দূর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থল লঘু নি¤œচাপে পরিণত হয়। এদিকে, ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ অতিক্রম করলেও এর প্রভাবে গতকাল সারাদিনই চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলে মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শামছুদ্দীন আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হবে। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশেই অবস্থান করছে। এটি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, তাই আরও বৃষ্টি ঝরিয়ে এটি দুর্বল হবে। ঘূর্ণিঝড়-পূর্ববর্তী আবহাওয়ায় ফিরে যেতে আরও ১০-১২ ঘণ্টা লাগবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সামসুদ্দিন আহমেদ আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় মোরা সিলেট হয়ে ভারতের মণিপুরে গিয়ে শেষ হবে। তবে সিলেটে ঝড় বা বাতাস না হলেও হালকা বা ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে কক্সবাজারের চকরিয়া থানার ওসি বখতিয়ার আহমদ জানান, ভোরে ঝড়ের সময় গাছচাপা পড়ে রহমত উল্লাহ ও সায়রা খাতুন নামে দুইজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া কক্সবাজার পৌরসভার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে মরিয়ম বেগম নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। ভোলার মনপুরায় আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার সময় মায়ের কোলে থাকা রাশেদ মণি নামে এক বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় মোরায় রাঙামাটি শহরে গাছচাপায় এক নারী ও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন শহরের আসামবস্তি এলাকায় হাজেরা খাতুন (৪৫) ও মসলিনপাড়ার নাসিমা আক্তার (১৩)।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানান, সকালে ঘূর্ণিঝড় মোরা সামান্য উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে আঘাত হানে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটার। তবে সাগরে ভাটা থাকার কারণে অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়েছেন উপকূলের মানুষ। আশঙ্কার তুলনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হওয়ায় সবাই স্বস্তি পেয়েছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা ৬ টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন পূবর্ -মধ্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় “মোরা” উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে আজ সকাল ০৬ টা থেকে দুপুর ১২ টার মধ্যে কুতুবদিয়ার নিকট দিয়ে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূল অতীক্রম সম্পন্ন করে দূর্বল হয়ে পড়েছে। এটি বর্তমানে স্থল গভীর নি¤œচাপ আকারে রাঙ্গামটি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দূর্বল হয়ে পড়তে পারে। দক্ষিণ পশ্চিম মওসুমী বায়ু চট্টগ্রাম উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। এর প্রভাবে ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অ¯’ায়ীভাবে দম্কা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বষর্ণ হতে পারে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে কুতুবদিয়ায় ১০০ মিলিমিটার। আর ঢাকায় হয়েছে ৬ মিলিমিটার।
এর আগে দুপুর দেড়টায় ‘মোরা’ সংক্রান্ত আবহাওয়ার সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞতিতে (১৭ নম্বর) বলা হয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরসমূহকে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ০৩ (তিন) নম্বর পুনঃ ০৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৮ (আট) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ০৩ (তিন) নম্বর পুনঃ ০৩ (তিন) নম্বর ¯’ানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অব¯’ানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার সমূহকে আজ রাত ০৯ টা পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে পরবতীর্তে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রামে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি
চট্টগ্রাম অফিস : গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টার পর ঘূর্ণিঝড় মোরা চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকুল অতিক্রম শুরু করে। এ সময় ঝড়ো হাওয়া, কখনও ভারি বৃষ্টি বয়ে যায়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ঝড়ে বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে সমুদ্র উপকুলের কাছে পতেংগা হালিশহর সহ বিভিন্ন স্থানে কাচাঁ ঘরবাড়ি বিধব্বস্তÍ হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ঝড়ো হাওয়ার কারণে ঘরবাড়ি বিধব্বস্ত হয় বলে জানা গেছে।
ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে বংগোপসাগর ছিল উওাল। বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে কিছুক্ষণের জন্য পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তবে দুপুর ১২টার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানায়, মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৬৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কক্সবাজার ও খেপুপাড়া রাডার পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় যে, উপকূল অতিক্রমরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে কুতুবদিয়ার নিকট দিয়ে কক্সবাজার- চট্রগ্রাম উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটি বর্তমানে স্থল গভীর নি¤œচাপ আকারে রাঙ্গামাটি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। স্থল গভীর নি¤œচাপটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। গভীর নি¤œচাপটির প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া সহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরসমূহকে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৮ (আট) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার সমূহকে মঙ্গলবার রাত ৯ টা পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে পরবর্তীতে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোরা উপকূল অতিক্রম করার পর চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল ৪টার পর থেকে বন্দরে পণ্য খালাসের কার্যক্রম শুরু হয়। বন্দরের জেটিতে আগে থেকে নামানো পণ্য ডেলিভারির এ কার্যক্রম শুরু হলেও বহির্নোঙরে থাকা জাহাজগুলো জেটিতে না ফেরায় পণ্য ওঠানামা শুরু হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, ঝড় থামার পর বিকাল থেকে ডেলিভারির কাজ শুরু হয়েছে। তবে জেটিতে এখনও কোনো জাহাজ বহির্নোঙর থেকে আসেনি। তাই জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামা শুরু হয়নি।
এর আগে ঘূর্ণিঝড় মোরা চট্টগ্রাম উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলে সোমবার সকাল থেকে বন্দরের বিভিন্ন কার্যক্রম ধাপে ধাপে বন্ধের পর সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারির পর সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বন্দরের জেটিতে থাকা মাদার ভেসেলগুলোকে বহির্নোঙরে সরিয়ে নেয়া হয়।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় কেটে যাওয়ায় চট্টগ্রামের শাহ আমানত এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার মোহাম্মদ রিয়াজুল কবির জানান, মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে ফ্লাইট অপারেশন শুরু করেছেন তারা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সরেজমিনে দেখার জন্য মঙ্গলবার সকাল ৯ থেকে উপকূলীয় এলাকার দক্ষিণ পতেঙ্গা, উত্তর পতেঙ্গা, দক্ষিণ হালিশহর সহ বিভিন্ন এলাকায় জনগণের পাশে ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র ¡ আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি প্রবলবর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়া উপেক্ষা করে নাগরিকদের হালচাল, গতিবিধি ও তাদের জীবন মান এবং ক্ষয়ক্ষতি, বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত নাগরিকদের জীবনমান সরেজমিনে দেখাশুনা করেন। এসময় তিনি আশ্রয়কেন্দ্র সমূহে আশ্রিত নাগরিকদের থাকা খাওয়া ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য চসিক এর সংশ্লিষ্ট শাখা ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের নির্দেশনা প্রদান করেন। এছাড়াও মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল বর্ষণ জনিত কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা জায়গা সমূহ চিহ্নিত করার জন্য প্রধান প্রকৌশলী সহ প্রকৌশলীদের সাথে নিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেন। তিনি জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণসমূহ খতিয়ে দেখে নিরসনের উদ্যোগ গ্রহনের জন্য প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক নির্দেশনা প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে, বৈরী আবহাওয়া থাকাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্ধার অভিযান ও নাগরিক সেবা অব্যাহত থাকবে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণীঝড় "মোরা" এর কারণে নগরীর বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আসা লোকজনদের বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জাতীয় সদর দপ্তরের সহযোগিতায়, চট্টগ্রাম সিটি ও জেলা ইউনিট এর তত্বাবধানে যুব রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের সদস্যরা ত্রাণ সহায়তা প্রদান করে। সোমবার রাত ১২ টায় নগরীর ৪১ নং ওয়ার্ডের লালদিয়া, মেরিন ফিশারীজ এবং বিমান বন্দর আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ২০০ জন আশ্রয়প্রার্থীদের জরুরী ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়। জরুরী ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে ছিল বিস্কিট, খাবার পানি, মোমবাতি এবং দিয়াশলাই। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম সিটি ইউনিটের সেক্রেটারি আব্দুল জব্বার, সিটি ইউনিটের কার্যকরি পর্ষদ সদস্য এইচ এম সালাউদ্দীন, যুব রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রামের সাংগঠনিক বিভাগীয় প্রধান ইসমাইল হক চৌধুরী ফয়সাল, প্রাক্তন কার্যকরি পর্ষদ সদস্য সজিব দেব, সাংগঠনিক বিভাগীয় উপ প্রধান মইনুল ইসলাম, প্রশিক্ষণ বিভাগীয় উপ প্রধান হাবিবুল বাশার রাফি সহ অন্যান্য যুব সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
‘মোরা’র আঘাতে কক্সবাজারে নিহত ৩ ॥ ২০ হাজার ঘর বিধ্বস্ত
কামাল হোসেন আজাদ, কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে কক্সবাজার জেলার দু’উপজেলায় তিনজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরো ১০ জন। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার ঘর। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানিয়েছে, ‘মোরা’ কবলে পড়ে জেলার চকরিয়ার উপজেলায় গাছ চাপায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন উপজেলার পূর্ববড়ভেওলার সিকদার পাড়ার মৃত নূরুল আলমের স্ত্রী সায়রা খাতুন (৬৫) ও ডুলহাজারার পূর্ব জুমখালীর আবদুল জাব্বারের পুত্র রহমত উল্লাহ (৫০)। তারা দু’জনই নিরাপদ আশ্রয়ের আসার পথে গাছ ভেঙে চাপা পড়ে মারা গেছেন। অন্যদিকে সোমবার কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়ে থাকাকালে ভয়ে স্ট্রোক করেন সমিতি পাড়ার বদিউল আলমের স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৬৪)। অসুস্থ হয়ে সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতেই মারা যান তিনি। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে আরো অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ পুরো জেলাতেই আঘাত করে। এর মধ্যে কঠোর আঘাত হেনেছে উপকূলীয় টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, মহেশখালীর ধলঘাটা, কুতুবজোম, কক্সবাজার শহরের ১নং ওয়ার্ড ও সদরের পোকখালীতে। তবে আট উপজেলাতেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেশি ক্ষগ্রিস্ত হয়েছে ঘরবাড়ির। জেলায় প্রায় ২০ হাজার কাঁচা ও পাকা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ব্যাপক গাছ-গাছালি, বিদ্যুৎ লাইন। ক্ষতি হয়েছে টেকনাফ ও মহেশখালী পানবরজ। এছাড়াও টেলিফোন লাইন, ডিস লাইন বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ লাইন বিছিন্ন হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে পুরো জেলা।
জেলা কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, প্রাথমিকভাবে প্রতি উপজেলায় এক লাখ টাকা ও ১০০ টন জিআর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেই সাথে আশ্রয় প্রার্থীদের মাঝে প্রতি উপজেলায় ২ হাজার প্যাকেট খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। মোট তিন আশ্রয়প্রার্থী খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শাহেদুল ইসলাম জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আরো আসতে পারে। পূর্ণাঙ্গ পরিমাপের জন্য জরিপ করা হবে। জরিপেই পুরো ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
মহেশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হোসাইন ইব্রাহিম জানান, মহেশখালীতে পানের বরজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ পানের বরজ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে পাহাড়ি বরজের সংখ্যা বেশি।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘তাৎক্ষণিক জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত জানতে সময় লাগবে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়া হবে। ’
এইচ, এম, হুমায়ুনকবির কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লে ও ঘূর্ণিঝড় মোরার বৈরী আবহাওয়ার প্রভাবে মাছ শিকার করতে পারছেনা জেলেনা। কুয়াকাটাসহ উপকূলীয় এলাকার মাছধরা ট্রলার তীরে ফিরে আসছে। সোমবার-মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ট্রলার মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরের পোতাশ্রয় শিববাড়িয়া নদীতে প্রায় পাঁচ শতাধীক মাছ ধরা ট্রলার নিরাপাদ আশ্রয়ে নিয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রে মাছ শিকারগামী জেলেরা ৬-৭ দিন সমুদ্রে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে ইলিশের সন্ধানে গভীর বঙ্গোপসাগরে যান। হঠাৎ আবহাওয়া ঘূর্ণিঝড় মোরার কারণে সমুদ্র উওাল হয়ে ওঠায় এবং আবহাওয়া ৮নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত থাকায় মাছ শিকার না করে এসব জেলে শুন্যহাতে তীরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। যার ফলে জ¦ালানি ও মৎস্য উপকরন মিলিয়ে প্রতিটি ট্রলারে অন্তত ৪০-৫০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে। ভোলা চরফ্যাশন এলাকার এফবি জিন্নাতারা ট্রলারের জেলে মামুন জানান, রবিবার সকালে ভোলা থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে বৈরি আবহাওয়া কারণে তিনি সোমবার বিকালে মৎস্য বন্দর আলীপুর ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এতে তাদের ট্রলারে বরফ, চাল ও জ¦ালানিসহ প্রায় ৪০ হাজার টাকার লোকসান হবে। কুয়াকাটা-আলীপুর ট্রলার মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা জানান, শিববাড়িয়া-নদীতে প্রায় পাঁচ শতাধীক মাছ ধরা ট্রলার নিরাপাদ আশ্রয়ে নিয়েছে। তাদেরকে আবহাওয়া ভাল-না-হওয়া-পর্যন্ত নিরাপদ থাকতে বলা হয়েছে। কলাপাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘূর্ণিঝড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা শাহ আলম জানান, ৮ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেতটি আরো দু-একদিন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সব মাছ ধরার ট্রলার ও নৌযানকে ৮ নম্বর নৌ-হুশিয়ারি সঙ্কেত দেয়া হয়েছে। তাই সব নৌযানকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে।
এম তরিকুল ইসলাম, লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) সংবাদদাতা : শিমুলিয়া-কাঠাঁলবাড়ি নৌরুটে সব ধরণের নৌ যান চলাচল মঙ্গলবারও বন্ধ ছিল। তবে সীমিত আকার ফেরি চলাচল অব্যাহত ছিল। ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে এখানে সকাল হতে দিন ভর থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়।
শিমুলিয়ায় ছিল ৩ নম্বর সংকেত চলছে। তবে সীমিত আকারে ফেরি চলাচল অব্যাহত ছিল। ফেরি কম চলাচল করায় দু’পারে ৪শ’ যান পারপারের অক্ষোয় আটকা পড়ে। বিআইডব্লিউটিএর বন্দর কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন জানান, ১ নম্বর সঙ্কেত থাকা অবস্থায়ই সোমবার বিকালে সব নৌ যান বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে অবস্থা আরও প্রকট। পাশের চাঁদপুরের ৮ নম্বর উপকূলীয় সঙ্কেত চলছে। নদী উত্তাল। তাই যে কোন ধরনের নৌ যান চলাচলে নিষেধ করা হয়েছে। তবে সীমিত আকারে কয়েকটি ফেরি চলছে মাত্র।
শিমুলিয়াস্থ বিআইডব্লিউটিসির এজিএম খন্দকার শাহ মো. খালেদ নেয়াজ জানান, পদ্মা উত্তাল থাকায় সোমবার রাত ৮টা থেকে ফেরি চলাচল সীমিত করা হয়েছে। তিনি মঙ্গলবারের চিত্র বর্ণণা করে জানান, ৩টি রোরো, ৩ টি কে-টাইপ, ২টি মাঝারী এবং উচ্চ ক্ষমতার টাগ বোড দিয়ে ২টি ডাম্পসহ মোট ১০টি ফেরি সর্তকতার সাথে চলাচল করেছে। দু’পারে যান বাহনের চাপ বৃদ্ধি পেলে মঙ্গলবার দুপুরের পরে শিমুলিয়া ঘাটের যানজট প্রায় হালকা হয়ে যায়। লঞ্চ, সিবোর্ট ও ট্রলার না চলায় ফেরিতে ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। কোন কোন ফেরিতে যাত্রী চাপে গাড়ীর সংখ্যা কমিয়ে দিতে হয়েছে। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হলেও ফেরি চলাচলে তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

http://www.dailysangram.com/post/286041-