৩১ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৭

ব্যাংকিং সেক্টরে অস্থিরতা

|| সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা ||

সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম জাস্টিস হাবিবুর রহমান খেদোক্তি করেই বলেছিলেন, ‘বাজিকররা এখন দেশ চালাচ্ছে’। তিনি এমন সময় এই অনুযোগ করেছিলেন যখন দেশে চাঁদাবাজ, দলবাজ, জুলুমবাজ, দখলবাজ, চাপাবাজ ও গলাবাজের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছিল। সে অবস্থা এখনো অব্যাহত আছে। এসব দেখতে দেখতে মানুষের যেন একেবারে গা-সওয়া হয়ে গেছে।
মরহুম বিচারপতির এই কথাটা অনেকটা শূলের মতো বিঁধেছিল ‘বাজিকর’ ও তাদের অনুগামীদের গায়ে। আঁতে ঘা লাগলে তো এমনটিই হওয়ার কথা। তখন মরহুম প্রধান বিচারপতির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি এসব রাজবাজিকর ও তাদের অনুগামীরা। কারণ, তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কথা অমূলক নয়; বরং তিনি তার কথায় দেশের বাস্তবচিত্রই তুলে ধরেছিলেন।
আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু আতঙ্কটা হলো মনুষ্য প্রজাতির হাঙ্গর-কুমিরদের নিয়ে। ইতরপ্রজাতির হাঙ্গর-কুমিরদের লোভে সীমা-পরিসীমা থাকলেও মনুষ্য প্রজাতির হাঙ্গরদের তা মোটেই নেই। এরা যখন সর্বগ্রাসী হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন এদের আর খাইয়ের শেষ থাকে না। যতক্ষণ জীবন থাকে ততক্ষণ এদের জঠরঅগ্নি অনির্বাণ। যা পায়, তাই একেবারে ছাই ভস্ম করে ফেলে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে এদের প্রাদুর্ভাবটা বেশ চোখে পড়ার মতো। রাজকোষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এদের ক্ষুৎ-পিপাসা থেকে মোটেই রেহাই পাচ্ছে না।
এর আগে এরাই শেয়ারবাজার থেকে লাখ কোটি টাকা সাবাড় করেছে। এদের জঠরজ্বালার ইন্ধন হয়েই সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারি ঘটেছে এবং বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বস্বান্ত হয়েছে। কিন্তু এদের উদরপূর্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এমনকি অতি ভক্ষণের জন্য পীড়াও এদের ওপর আছড় করতে পারেনি।
রাষ্ট্রের সব সেক্টরেই যখন দুর্নীতি, লুটপাট ও অনিয়মের জয়জয়কার, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর ঢেউটা আছড়ে পড়েছে আমাদের ব্যাংকিং খাতেও। খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটতরাজের কারণে খেলাপির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারছে না ব্যাংকিং খাত। ক্রমেই বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। অনেকেই এই প্রতিবেদনকে অর্থনৈতিক সেক্টরের জন্য অশনিসঙ্কেত হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত জানুয়ারির আগে ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ থাকলেও মার্চে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর সাথে ৪২ হাজার কোটি টাকার অবলোপন যোগ করলে দাঁড়াবে এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে জুনেও নিশ্চিতভাবে অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল। তা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে ব্যাংকের তহবিলে যে বিশেষ সঞ্চিতি বা সঞ্চয় রাখতে হয়, সেখানেও ব্যর্থ হয়েছে ৬টি ব্যাংক। এর মধ্যে সরকারি ৩টি ও বেসরকারি ৩টি। অর্থাৎ খেলাপি, অবলোপন ও প্রভিশনের মানদণ্ডে ব্যাংকগুলো চোরাবালিতে আটকা পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না; বরং তা ক্রমেই খারাপের দিকেই যাচ্ছে। আমাদের জন্য যে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে এমনটা আশা করা খুব একটা যৌক্তিক হবে না।
জানা গেছে, প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, বেসিক ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থা খুবই করুণ। ব্যাংক তিনটির প্রভিশন ঘাটতি ৬ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের বিচার না হওয়ায় সীমাহীন দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। আসলে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিই ব্যাংকিং সেক্টরে ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য দায়ী। লুটপাটে ও সীমাহীন অনিয়মে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। উদরপূর্তি করছে সর্বগ্রাসীরা। পরোভাবে এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। এভাবে ব্যাংকগুলো ডুবতে বসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্যমতে, সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখার কথা ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু প্রভিশন রাখা হয়েছে ১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এর অর্থ, ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বেসিক ব্যাংক। একইভাবে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখার কথা ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। কিন্তু প্রভিশন রেখেছে ৪ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। ২ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার পরিবর্তে রেখেছে মাত্র ১ হাজার ১ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ১ হাজার২০৯ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার পরিবর্তে ব্যাংকটি রেখেছে মাত্র ৬৯৮ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ৭১৭ কোটি টাকা। ৪৪৬ কোটি টাকার পরিবর্তে প্রভিশন রেখেছে মাত্র ২৩৩ কোটি টাকা।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ‘ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন’। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেয়া হচ্ছে, তা পূরণ হচ্ছে না। ঋণের অপব্যবহারই হচ্ছে বেশি। অর্থ পাচারও হচ্ছে দেদার। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ব্যবসায়ীরাই নাকি ঠিক করছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে কারা আসবেন।
মূলত মতাসীন দল ও জোটের লোকজনের যোগসাজশে ঋণ দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণেই ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রাক-যোগ্যতা যাচাই করা হচ্ছে না। সে কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। আর অর্থঋণ ও দেউলিয়া আদালতের মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের কোনো বিচারও হচ্ছে না। এ কারণে ঋণখেলাপিরা সাহস পেয়ে গেছে। এদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি আমলে নেয়া হচ্ছে না। এ দিকে, অবলোপন করা ঋণের তথ্য গোপন করে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। এ ঋণও খেলাপি এবং সুদ আরোপ হচ্ছে। ঋণখেলাপি রাঘববোয়ালদের শাস্তি হলেই খেলাপি ঋণ কমে আসবে।
ব্যাংকিং খাতের করুণ পরিণতি একদিনে হয়নি। অধিকাংশ েেত্র জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নেই। বিচারহীনতা ও অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়াও এ অবস্থার উল্লেখযোগ্য কারণ। গত কয়েক বছরে খাতটিতে খুব বেশি পরিবর্তন বা সংস্কার হয়নি। অর্থ পাচারের কারণে খেলাপি ঋণ হু-হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত মার্চ মাসের শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৯৭ হাজার ১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের ৩৫ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের। ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। বিদেশী ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৭২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সে টাকাই এখন ধীরে ধীরে ‘খেলাপি’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ ব্যাংক খাতকে আরো খারাপ করে তুলবে বলেই মনে করছে অভিজ্ঞমহল। সরকারি ব্যাংকে পুনর্গঠিত বড় কিছু ঋণ আদায় হয়নি। অবশ্য মার্চ মাসে খেলাপি ঋণ একটুবাড়েই। আগামী প্রান্তিকে কিছুটা কমে আসতে পারে।
সরকারের উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততার কারণেই রাষ্ট্রের সকল বিভাগেই চলছে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই। আইনের শাসন তেমন কার্যকর আছে বলে মনে হয় না। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ধর্ষণ, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অর্থনৈতিক সেক্টরও পড়েছে রাজরাক্ষস ও সর্বগ্রাসীদের হাতে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। ঋণ দেয়া নেয়ার ব্যাপারে নিয়মনীতি অনুসরণ না করায় খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। আর এসবের সাথে যুক্ত রয়েছে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সর্বভুকবাহিনী। তাই অনতিবিলম্বে এদের দৌরাত্ম্য রোধ করা না গেলে দেশের ব্যাংকিং খাতসহ অর্থনৈতিক সেক্টর ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/224314