৩১ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৫

সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা সিইসির একক বিষয় নয়

সুশাসন

|| ইকতেদার আহমেদ ||

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনারদের পদের মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ-পরবর্তী যে তারিখে তারা প্রধান বিচারপতি পঠিত শপথবাক্য পাঠ করেন সে তারিখেই কার্যভার গ্রহণ করেন। নির্বাচন কমিশনের সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সভাপতিত্ব করেন।
নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে যেসব দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদের নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে, ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় সংসদের নির্বাচন এবং সংসদে কোনো সদস্যপদ শূন্য হলে কোন তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কমিশনের বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সব সদস্য সমান ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। সুতরাং নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখের বিষয়ে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যে তারিখ নির্ধারিত হবে, এ প্রশ্নে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়।
সংসদের কোনো সদস্য পদ শূন্য হলে শূন্য হওয়ার তারিখ থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে শূন্য পদ পূর্ণ করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কোনো দৈবদুর্বিপাকের কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে ওই সময়ের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সিইসি বা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দেয়া হয়েছে। সংবিধানের বিধান মতে, এটি তার একক ক্ষমতা। দৈবদুর্বিপাকজনিত কারণে শূন্য পদ পূরণের নিমিত্ত নির্বাচনের তারিখ বর্ধিত করার প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি এককভাবে সময় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন; তবে বর্ধিত সময়ের কোন্ তারিখে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একক এখতিয়ারের বিষয়টি সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকায় অনুধাবন করা যায়, সংসদ নির্বাচনের তারিখের মতো এ নির্বাচনটির তারিখও কমিশনের সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
দশম সংসদ নির্বাচন ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠানের পর ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। একটি সংসদের মেয়াদকাল প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠানের তারিখ থেকে পাঁচ বছর। বর্তমান সংসদের মেয়াদ ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালে পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিধায় একাদশ সংসদ নির্বাচন ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালের পূর্ববর্তী ৯০ দিন সময়, অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ সাল থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালের মধ্যে যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
বিগত এক বছর ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে একাদশ সংসদ নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের আগেই অনুষ্ঠানের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে রাজনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, ২০১৮ সালের প্রথম দু’মাসের যেকোনো দিন একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ আলোচনাটি চলমান থাকাকালে গত ১৮ মে ভারতের ঢাকাস্থ হাইকমিশনার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে হাইকমিশনারের সাথে তার কার্যালয়ের দু’জন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অপর দিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে উপস্থিত ছিলেন। সে নিরিখে এ বৈঠকটিকে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হিসেবে অভিহিত করা যায়। সাক্ষাৎ-পরবর্তী ভারতের হাইকমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সময়ের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে তার আলোচনা হয়েছে। সাক্ষাতের পরের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যক্ত করেন যে, ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের যেকোনো সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নির্বাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের; এককভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নয়। সংবিধান প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এরূপ একক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো ক্ষমতা দেয়নি।
আমাদের দশম সংসদ নির্বাচনের সময়ও দেখা গেছে, ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বিশেষ বিমানযোগে ঝটিকা সফরে ঢাকায় আগমন করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও জাতীয় পার্টি প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে নির্বাচনটিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি অনীহা ছিল বিধায় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জাতীয় পার্টি প্রধানের কাছে এ মর্মে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে, তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে এ দেশে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট ধর্মীয় উগ্রবাদের আবির্ভাব ঘটবে। বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান-পরবর্তী দেড় বছরের মাথায় ভারতে যে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পরাভূত হয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) ক্ষমতাসীন হয়েছে। আর এ কারণে স্বভাবতই প্রশ্নের উদয় হয়, যারা নিজ দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান রোধে ব্যর্থ, তারা কী করে অপর দেশে এসে নির্বাচনে একটি দলের বিজয় ঘটলে দেশটিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের আবির্ভাব ঘটবে, এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেন?
জাতীয় সংসদ এবং সংসদের শূন্য পদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তফসিল ঘোষণার বিষয়টি এ পর্যন্ত কমিশনের সভায় আলোচনান্তে গৃহীত হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে কমিশনের মধ্যে কখনো কোনো ধরনের মতদ্বৈধতা হয়েছিল কিনা এবং কখনো সিদ্ধান্তটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে হয়েছিল কিনা এমন সংবাদ ইতঃপূর্বে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের অভিপ্রায় নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করেছিলÑ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কখনো এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। এ বাস্তবতায় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের হাইকমিশনারের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে নির্বাচনের প্রস্তুতি, বিশেষত সময় নিয়ে আলোচনা অন্য নির্বাচন কমিশনারদের সাংবিধানিক ক্ষমতার কর্তৃত্বকে খর্ব করেছে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশন সে দেশের লোকসভা নির্বাচন বিষয়ে অপর কোনো রাষ্ট্রের হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূতের এ ধরনের কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ যে বরদাস্ত করবে না, এ প্রশ্নে সে দেশের কোনো নাগরিকের মধ্যে সংশয় নেই। তাই স্বভাবতই প্রশ্নের উদয় হয়, আমাদের সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে কেন তাদের পররাষ্ট্র সচিব ও হাইকমিশনারের অযাচিত আচরণের মাধ্যমে নিজ সরকারের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের প্রয়াস?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণ শপথের অধীন বিধায় শপথ গ্রহণকালে তাদের প্রত্যেককে অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি বলতে হয়, তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। সংবিধান জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ ঘোষণার বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কোনো ধরনের একক ক্ষমতা দেয়নি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, কমিশনের বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ নির্ধারিত হওয়া আবশ্যক। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং গণমাধ্যমে তার প্রকাশ অপরাপর নির্বাচন কমিশনারের সাংবিধানিক ক্ষমতার হানি ঘটায়।
‘নির্বাচন কমিশন’ বলতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর নির্বাচন কমিশনারকে বুঝায়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে ‘নির্বাচন কমিশন’ নন। নির্বাচন কমিশনের সাথে কোনো রাজনৈতিক দল বা অপর কোনো দেশের প্রতিনিধির যেকোনো নীতিনির্ধারণী বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে কমিশনের সব সদস্যের উপস্থিতি কাম্য। নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ ঘোষণা কমিশনের নীতিনির্ধারণী কাজের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এ সিদ্ধান্তটি কমিশনের বৈঠকে গৃহীত হওয়া ব্যতীত অপর কোনো বিকল্প নেই। এবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে এককভাবে ভারতের হাইকমিশনারের বৈঠক এবং সে বৈঠক থেকে নির্বাচন কমিশনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত, যেমন অনানুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতার চরম অবমাননা। এর মাধ্যমে যে সংবিধান লঙ্ঘিত হয়, যেকোনো সাংবিধানিক পদধারী এ বিষয়ে সজাগ থাকলে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ ঘটে না। আর এ ধরনের বিতর্ক যে, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করে, তা এ দেশের সচেতন জনমানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেখানে তফসিল ও তারিখ ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারেরই কোনো কর্তৃত্ব নেই, সেখানে অন্য রাষ্ট্রের হাইকমিশনারের কেন অযাচিতভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সময় বিষয়ে বৈঠক ও অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার অবতারণা?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/224316