৩০ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৫

শ্রমশক্তি নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য

দেশে বেকার সাড়ে ৪ কোটি

সরকারের দাবি ২৬ লাখ : সরকারি তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়, বেকারের সংখ্যা আরও অনেক বেশি -ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য * বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হবে কিভাবে -প্রশ্ন ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের

দেশে বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লাখ। কিন্তু সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, মাত্র ২৬ লাখ। এছাড়া সরকার দাবি করছে গত দেড় বছরে দেশে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ১৪ লাখ। আর এমন তথ্য জায়েজ করতে বেকারত্ব নির্ণয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের এসব তথ্য একেবারে বিভ্রান্তিকর। এর মাধ্যমে মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে। কারণ আইএলওর সংজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাদের মতে, গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত সত্য হল- বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির। ফলে কর্মসংস্থানকেও স্থবির বলতে হবে। একেবারে কিছু যে সৃষ্টি হয়নি তা নয়। কিন্তু যেখানে বেসরকারি খাত মোট কর্মসংস্থানের ৮০ ভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে সেখানে বিনিয়োগে ভাটা পড়ায় বিপুলসংখ্যক শ্রমশক্তি নির্ঘাত বেকার থেকেই যাচ্ছে।


জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ২৬ লাখ বেকারের হিসাব বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তিনি বলেন, আইএলও বেকারের যে সংজ্ঞা দেয়, সেটি উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। উন্নত দেশের জন্য। কারণ উন্নত দেশে বেকার ভাতা দেয়া হয়। তাই অনেকে ইচ্ছে করেই বেকার থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন, দেশে যেখানে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না সেখানে দেড় বছরে ১৪ লাখ কর্মসংস্থানও হয় কিভাবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, দেশে ২৬ লাখ বেকার এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা শ্রমিক পর্যায়ে কিছুটা কাজ থাকলেও মধ্যম পর্যায়ে কাজ কম। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি।

সরকারি হিসাব মতে, দেড় বছরে দেশে ৪০ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে ছিল। সেখান থেকে ১৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। মোট বেকারের ৩৫ শতাংশের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে দেশে একটি পিয়ন পদে চাকরির জন্য কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ে, সেখানে এ তথ্য ভিত্তিহীন এবং মানুষকে বোকা বানানোর কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, ভারতে সম্প্রতি চতুর্থ শ্রেণীর গ্রেডে ৬ হাজার পদের বিপরীতে ২৫ লাখ আবেদন পড়েছিল। আর ভারতের মতো দেশে এ অবস্থা হলে বাংলাদেশের অবস্থা তো আরও করুণ। সেখানে মাত্র ২৬ লাখ বেকার কিভাবে হয়। তারা বলেন, এ বিষয়ে বাস্তব চিত্র পেতে বেশি দূর যাওয়া লাগবে না। একটি গ্রাম ঘুরে জরিপ করলেই জানা যাবে কতজন দক্ষ ও অদক্ষ বেকার বসে আছেন। সময়মতো কাজ কিংবা চাকরি না পেয়ে অনেক শিক্ষিত বেকার হতাশায় নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছেন। এছাড়া অর্ধশিক্ষিত ও কমবেশি শিক্ষিত দক্ষ-অদক্ষ বেকার তো প্রতি বাড়িতেই কমপক্ষে ২-১ জন পাওয়া যাবে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত সত্য হল বিনিয়োগ বাড়েনি। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া কঠিন। তিনি বলেন, বিনিয়োগের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। বিশেষ করে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বিনিয়োগের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। ফলে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ছাড়া অন্যান্য সূচকগুলো বাড়লে, ওই বৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি বলেন, ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে। তাই এ খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হবে কিভাবে।

শ্রমশ্রক্তি নিয়ে রোববার একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে যাদের বয়স ১৫ বছরের বেশি তাদের সংখ্যা ১০ কোটি ৬১ লাখ। বিবিএসের বিবেচনায় এদের মধ্যে কাজ করতে সক্ষম ৬ কোটি ২১ লাখ। বিবিএস দাবি করছে, এসব কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে কাজ করছে ৫ কোটি ৯৫ লাখ। এ হিসাবে বাকি ২৬ লাখ লোক বেকার। বিবিএস ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত জরিপ করে এমন পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।

এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিবিএসের তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে। যেমন- বিবিএস তার অপর এক তথ্যে বলছে, ১৫ বছরের উপরে বয়স হলেও এমন অনেকে আছেন যারা সরাসরি শ্রমিক নন তাদের সংখ্যা নাকি ৪ কোটি ৪০ লাখ। আসলে এখানেই গলদ। আইএলওর সংজ্ঞা ব্যবহার করে বিশাল এ শ্রমশক্তিকে বেকার হিসেবে দেখাচ্ছে না সরকারি এ সংস্থা। বাস্তবতা হল এরাও বেকার। এ প্রসঙ্গে বিবিএসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী এরা বেকারও নন, আবার কর্মেও যুক্ত নন। কিন্তু বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় এরাও বেকার। খোদ সংস্থাটির নিজস্ব হিসাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে এ চার কোটি ৪০ লাখ বেকারের তথ্য গোপন করা হয়েছে। ফলে ৬ লাখ একেবারেই বেকার যোগ করলে প্রকৃত বেকার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটি ৬৬ লাখ।

আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ৪ সপ্তাহ কাজ খুঁজেছে অথচ পায়নি, কিন্তু আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে কাজ পেতে পারে বা আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যেই বিদ্যমান মজুরিতে কাজ শুরু করবে এমন মানুষকে বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিবিএস বাংলাদেশের শ্রমশক্তির যে জরিপ করেছে, তা এ সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করা।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল- গত কয়েক বছর বেকার সংখ্যা ২৬ লাখে স্থির রয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব? পরিসংখ্যানের দিক থেকে অবশ্যই কম বা বেশি হওয়ার কথা। এক্ষেত্রে তো প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মেলালে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা। কিন্তু এ তথ্যেও কোনো মিল নেই। এখানে হিসাবের গরমিল থাকতে পারে। তিনি বলেন, মূল কর্মসংস্থান তৈরি করে বেসরকারি খাত। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই। তাছাড়া পোশাক খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, প্রবৃদ্ধি যে হারে (৭ শতাংশ) বাড়ছে, তাতে এক বছরে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ১৪ লাখ। কিন্তু বিবিএস বলছে ৯ লাখ ৩৩ হাজার। এখানে হয় প্রবৃদ্ধিতে সমস্যা, না হয় বিবিএসের হিসাবে সমস্যা। তিনি বলেন, গোঁজামিল দিয়ে হিসাব দিলে হবে না।

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে ২ কোটির উপরে লোক বেকার। এরপর প্রতিবছর নতুন করে ১৫ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন। এদের বড় অংশই বেকার থাকছেন।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/30/128515/