৩০ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩০

খেলাপি ঋণ খেয়ে ফেলেছে মূলধন

মার্চে ৯ ব্যাংকের ঘাটতি ১৬ হাজার কোটি টাকা

নানা উদ্যোগের পরও মূলধন ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না সরকারি-বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক। খেলাপি ঋণের তালিকারও শীর্ষে তারা। গত মার্চে ৯ ব্যাংকে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ৫৭ শতাংশ। বিপুল পরিমাণের এই খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন খেয়ে ফেলেছে।

এর পরও জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোতে বছরের পর বছর ধরে মূলধন জোগান দিয়ে আসছে সরকার। আগামী বাজেটেও এসব ব্যাংকের জন্য দুই হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে বিতরণ করা ঋণ আর আদায় না হওয়ায় এসব ব্যাংকের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ সমকালকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অপশাসনের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডি তারাই নিযুক্ত করেছেন।

নিয়োগপ্রাপ্তরা ব্যাংকে শুধু খেলাপি ঋণ বাড়িয়েছেন তা নয়, এসব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির বীজ বপন করেছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো এখন দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বাজেটে এসব ব্যাংকের জন্য যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে, তা অনৈতিক। এ প্রবণতা বন্ধ করা উচিত। তিনি বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা না দিলে দুর্নীতি কমবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত ৫৭টি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ রয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোতে ৪১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। পুরো ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ খেলাপি হলেও মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোতে গড়ে ২৮ শতাংশের মতো ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেসিকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে দুই হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে ৭৭৯ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৬৩৮ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ৪৪৩ কোটি ও জনতা ব্যাংকে ৭০ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। আর বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৩৪০ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের মধ্যে গত ডিসেম্বরে অগ্রণী ও জনতা ছাড়া বাকি সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল। ৯টি ব্যাংকের পরিস্থিতি খারাপ হলেও অনেক ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মূলধন রেখেছে। গত মার্চে ব্যাংকগুলোর ৮২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা প্রয়োজনের বিপরীতে সব ব্যাংক মিলে সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। দশ শতাংশ প্রয়োজনের বিপরীতে সংরক্ষণের হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সমকালকে বলেন, হলমার্ক ছাড়া নতুন করে সোনালী ব্যাংকে তেমন খেলাপি হয়নি। আগের খেলাপি ঋণ সরকারি ব্যাংকগুলোকে চাপে রেখেছে। বছরের পর বছর ধরে সেসব খেলাপি টানতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়েছে। সরকার একবারে কখনও পুরো মূলধন মেটানোর মতো অর্থ দেয়নি। যদিও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে এসব ব্যাংক পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করছে।

সরকারি ব্যাংকগুলোর দক্ষতা না বাড়িয়ে জনগণের করের টাকায় বারবার মূলধন জোগান নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। এর পরও প্রায় প্রতিবছরের বাজেটে আলাদা করে টাকা রাখছে সরকার। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও মূলধনের ঘাটতি মেটানোর জন্য দুই হাজার কোটি টাকা সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে মূলধন ঘাটতি মেটাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও বিভিন্ন ব্যাংককে দেওয়া হয় পাঁচ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪২০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়। গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকের দক্ষতা বাড়িয়ে মূলধন ঘাটতি কমানোর কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।

http://bangla.samakal.net/2017/05/30/296883