৩০ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২২

৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা

সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক নামে অখ্যাত কোম্পানির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ও বিসমিল্লাহসহ বিভিন্ন কোম্পানির ঋণ কেলেঙ্কারিতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে গেছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় মূলধন ঘাটতিও বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত মার্চ শেষে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি সরকারি ৭ ব্যাংকসহ ৯ ব্যাংক। আলোচ্য ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩১ মার্চভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের এক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। মূলধন ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলো হলো, সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক বছর সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, বেসিকসহ বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। ওই সব ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের খাতায় মন্দঋণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু এসব মন্দঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাওয়া মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। এটা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতাই ফুটে উঠেছে। এর ফলে শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসবে। বিদেশী বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর সাথে বিদেশী ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে গ্যারান্টি হিসেবে তাদের বাড়তি ফি দিতে হচ্ছে। যার প্রভাবে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে গেছে।
এ দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি ও লুটপাটের দায় জনগণের ঘাড়েও চাপানো হচ্ছে। কেননা, দুর্নীতির দায় দায় মেটানো হচ্ছে জনগণের অর্থ দিয়ে। গত তিন বছরে সরকারি ৬ ব্যাংকের ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৭ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগান দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংককে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। আর বেসিক ব্যাংককে দেয়া হযেছে ২ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬টি সরকারি ব্যাংকের ৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংককে মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৮১৪ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৮১ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ২১০ কোটি টাকা। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে বিশেষ বরাদ্দ থাকছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে বের করে নেয়া হয় সোনালী ব্যাংক থেকে। এ অর্থের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা তা আজো বের হয়নি। অথচ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাকে এ জন্য শাস্তি দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ২০১২ থেকে শুরু করে মাত্র দুই বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের ওই সময়ের পরিচালন পর্ষদের সদস্যরা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ নামক একটি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। পানির মতো টাকা বের হয়ে গিয়েছে রূপালী ব্যাংক থেকে। বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি নির্বিঘেœ দেশ ছেড়েছে। এসব অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর বিশাল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি মেটানো হচ্ছে জনগণের করের অর্থ দিয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, নানা কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা মনে করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অন্যতম সমস্যা হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কারণ, এক দিকে পরিচালনা পর্ষদে যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয় তাদের বেশির ভাগই সরকারি দলের সমর্থক, অপর দিকে, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক চাপ। রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে ঋণের চাপ আসে। আবার ওই ঋণ অনুমোদন দেয়া হয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। ফলে যারা ঋণ নেন, তারাও কোনো-না-কোনোভাবে সরকারি আদর্শে বিশ্বাসী। এতে যে ঋণ দেয়া হয় তা আর ফেরত আসে না। এভাবেই সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে যাচ্ছে। আবার ব্যাংক থেকে এসব ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া কঠিন। কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট না দিয়েই অনেকেই ঋণ নবায়ন করছে। এটাও পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে। কিন্তু দিনশেষে সব দোষ চাপে ব্যাংকের এমডিসহ কর্মকর্তাদের ওপর। ওই এমডি মনে করেন, রাজনৈতিক চাপ না আসলে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফিরে আসতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশিষ পরিসংখ্যান মতে, গত মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা টাকা। এ অর্থ গত ডিসেম্বরে ছিল ৭ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯টি ব্যাংক ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। ফলে তাদের ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ৪৪২ কোটি টাকা, যেখানে তিন মাস আগে উদ্বৃত্ত ছিল ৪৬ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা, যেখানে ৩ মাস আগে ছিল ২ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। তিন মাস আগে জনতা ব্যাংকের মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল ৭৩ কোটি টাকা, সেখানে তিন মাস পরে অর্থাৎ মার্চে এসে মূলধন ঘাটতি হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। তবে তিন মাসে রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি কমেছে ৭৭ কোটি টাকা কমেছে। ডিসেম্বরে ঘাটতি ছিল ৭১৪ কোটি টাকা, সেখানে মার্চে এসে হয়েছে ৬৩৭ কোটি টাকা। অপর দিকে সোনালী ব্যাংকের তিন মাসের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি ৯১৭ কোটি টাকা কমে নেমেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকায়। যেখানে ডিসেম্বরে এ ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। অপর দিকে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৩৯ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ২৫২ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭৭৮ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/224104