বাজেট ২০১৭–১৮
৩০ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২২

প্রাক্‌–বাজেট ২০১৭–১৮

করের টাকা যাচ্ছে সরকারি ব্যাংকে

মানুষের করের টাকা রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দিয়ে দিচ্ছে সরকার। সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায় করে সরকার। আর এর একটি অংশ সরকারই দিয়ে দিচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলোকে।

একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি ও ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে আছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে এখন বাজেট বরাদ্দ দিয়ে। প্রতিবছরের বাজেটেই ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়ার জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আগামী ১ জুন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের যে বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন, তাতেও ব্যাংকগুলোকে দেওয়ার জন্য রাখা হচ্ছে ২ হাজার কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। সিপিডি বলেছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত (২০১৬-১৭ অর্থবছর বাদে) আট বছরের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয় থেকে সরকার গড়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থ দিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগানে।
সিপিডি অঙ্ক করে দেখিয়েছে, ৮ বছরের মোট রাজস্ব আয় ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা এবং মোট ক্রমবর্ধমান (এক বছর থেকে আরেক বছরে যত টাকা বেশি) রাজস্ব আয় ১ লাখ ৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এই ৮ বছরের মধ্যে ৭ বছরই পুনর্মূলধনের নামে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা, যা ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয়ের ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ রাজস্ব আয়ের ভালো একটা অংশ চলে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর জন্য।
সিপিডি বলছে, সম্পদ ঘাটতির বাংলাদেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে যেভাবে টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা দিতে না হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সামাজিক খাতে টাকাগুলো খরচ করা যেত। এতে দেশও অনেক বেশি উপকৃত হতো।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের আর্থিক বিবৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এমন কোনো বছর নেই, যে বছর মূলধন বাবদ ব্যাংকগুলোকে টাকা দিতে হয়নি। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ৮ বছরে দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের জন্য রাখা হয়েছিল ২ হাজার কোটি টাকা, যা থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এরই মধ্যে বেসিক, সোনালী, রূপালী—এসব ব্যাংককে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কয়েক বছর ধরেই বাজেট বক্তব্যে এ বিষয়ে কোনো যুক্তি তুলে ধরছেন না অর্থমন্ত্রী। তিনি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্যাংক খাতের কার্যক্রম মূল্যায়নে একটি কমিশন গঠন করবেন। দুই বছর পার হতে চলেছে, তা-ও করেননি তিনি। বরং উদ্যোক্তাদের চাপে বেসরকারি ব্যাংকে আইন শিথিল করে ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক পরিবারের চারজন এখন পরিচালক হতে পারবেন আর তাঁরা থাকবেন নয় বছর। এর ফলে বেসরকারি ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতি হবে বলে আশঙ্কা করছেন সাবেক ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা। যদিও সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে গত ৬ ফেব্রুয়ারি অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে তিনি ব্যাংক কমিশন করবেন।
ব্যাংকগুলোকে অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা দেওয়ার সময় প্রতিবারই বলে দিচ্ছে যে খেলাপি ঋণ আদায়ে তাদের মনোযোগী হতে হবে। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরও বাড়ছে। ২০১৬ সালেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, ঋণের নামে সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা আত্মসাতের কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চলমান অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংকে মুন গ্রুপ কেলেঙ্কারি, রূপালী ব্যাংকে ‘গোল্ড আনোয়ার’সহ আরও কেলেঙ্কারি হয়েছে নতুন করে।
এর আগে সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ জালিয়াতি ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে পুরো বেসিক ব্যাংকেই বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ব্যাংকগুলো সূত্রে জানা গেছে, অন্তত এক হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকেই।
সরকার এ ঘটনাগুলোর নায়কদের বিচার করতে পারেনি, উল্টো বাজেটে বরাদ্দ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আসছে। বাজেট সংক্ষিপ্তসারের অনুন্নয়ন ব্যয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অংশে ব্যাংকগুলোর জন্য রাখা বরাদ্দকে দেখিয়ে আসছে ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে।
আবদুল হাইকে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সরকার ২০১৪ সালে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে আলাউদ্দিন এ মজিদকে, বেসিক ব্যাংক ভালো থাকাকালীন যিনি এর এমডি ছিলেন। জানতে চাইলে গতকাল মুঠোফোনে তিনি অকপটে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির বড় কারণ হচ্ছে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘুষ খাওয়া। তবে কিছু ক্ষেত্রে চাপও থাকে।’
তবে যৌক্তিক কারণেই রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় বলে মনে করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এ ব্যাংকগুলো মানুষকে যে সেবা দেয়, তার মূল্যকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বেশি অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়া ব্যাংকগুলোকেই তো বেশি টাকা দিতে হচ্ছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনুসুর রহমান বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির পরিণতি যে ভালো নয়, ব্যাংকগুলো তা দেখতেই পাচ্ছে। তবে এটা ঠিক, খেলাপি ঋণ আদায়ে তাদের মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে ঋণ বিতরণের সময় যাতে কোনো অনিয়ম না হয়। কারণ, ঋণ বিতরণের অনিয়মই খেলাপি ঋণ বাড়ায়।
উল্লেখ্য, সরকারি খাতের সোনালী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলছে। গত বছর শেষে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকে ২ হাজার ৬৮৪ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৭১৪ কোটি, বিকেবি ৭ হাজার ৮৩ কোটি ও রাকাবের মূলধন ঘাটতি এখন ৭৪২ কোটি টাকা।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতিপরায়ণ চেয়ারম্যান ও এমডি নিয়োগ দেওয়ার কারণেই ব্যাংকগুলোকে প্রতিবছর মূলধন জোগান দিতে হচ্ছে। এ অর্থে বলা যায়, সরকার দুর্নীতিকে পোষণ করছে। অথচ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারকে এসব ব্যাংক মুনাফা দেওয়ার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের অপসারণ করতে পারলেও সরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের পারে না—এ নিয়ম তুলে দিলে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করেন ইব্রাহিম খালেদ।

http://www.prothom-alo.com/economy/article/1198406/