৩০ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:০৯

বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব কাম্য নয়

সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের যে দ্বন্দ্ব বর্তমানে চলছে তা বন্ধ না হলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। বিচার বিভাগকে সরকারের অনুগত করার ব্যাপারে যে কোনো উদ্যোগের অর্থ হচ্ছে একদিকে শাসনতন্ত্র রক্ষায় বিচার বিভাগের ভূমিকা অস্বীকার করা, অন্যদিকে শাসনতন্ত্র যেসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে তা থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা।


শাসনতন্ত্র যদি তার স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষায় অপারগ হয় তাহলে সরকারও তার শাসনতান্ত্রিক বৈধতা হারিয়ে ফেলে। সুতরাং ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যারা জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্র ধ্বংস করতে আগ্রহী, তারা যেন সময় নিয়ে এর পরিণতির কথা ভেবে দেখেন।

বিচার বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি হঠাৎ কিছু নয়। নির্বাচন ও সংসদকে শাসনতান্ত্রিকভাবে অকার্যকর করার পরই সরাসরি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাহী বিভাগ। মানুষকে সম্পূর্ণভাবে অধিকারহীন ও অসহায় করার কাজটি সম্পন্ন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে মানুষের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।

বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের বিরোধের প্রত্যক্ষ সূত্রপাত ঘটে নিন্ম আদালতের চাকরি বিধির প্রজ্ঞাপন জারি সংক্রান্ত সুপ্রিমকোর্টের একটি নির্দোষ আদেশ পালনে বিরত থাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এরপর অধস্তন আদালতের জজদের অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশে ট্রেনিং নিতে পাঠানো হয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই।

এর আগে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা পার্লামেন্টকে অর্পণ করার অনুকূলে একটি আইন পাস করা হয় পার্লামেন্টে। এর অর্থ দাঁড়ায় পার্লামেন্টের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বরখাস্ত করতে পারবেন। মানুষের মৌলিক অধিকার এবং নিরপেক্ষ বিচার পাওয়ার সুযোগের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে কেউ সুপ্রিমকোর্টকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে পারে না। এটা সভ্য সমাজের বিপরীত চিন্তাভাবনা।

সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে এখন সুপ্রিমকোর্টের স্বাধীন অস্তিত্ব বিলোপের বিষয়টির শুনানি চলছে। ইতিমধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ এ আইনটিকে শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী ঘোষণা করেছে।

আইনটির বিরুদ্ধেই সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা তাদের মত দিচ্ছেন; কিন্তু বিশেষ শ্রেণীর প্রগতিশীল মহল নীরব। তারা মানবাধিকারের কথা বলবেন কোর্টে মামলা করতে এসে; কিন্তু বিচার বিভাগ আক্রান্ত হলে তারা কোনো দায়িত্ব নেবেন না। প্রতিবাদী ভূমিকা রাখবেন না। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর সাম্প্রদায়িকতার মধ্যেই তাদের প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা সীমাবদ্ধ। নানাবিধ অন্যায়-অবিচার ও নির্যাতনের ব্যাপারে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো প্রগতিশীল শ্রেণী-গোষ্ঠী জনগণের কোনো কাজে আসছে না। এটা আমাদের দেশের জন্য দুর্ভাগ্যই বলব।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার আইনের শাসন অস্বীকার এবং মানবাধিকার নিয়ে খেলা করার জন্য অসীম ক্ষমতা হাতের মুঠোয় নিতে অতি উৎসাহ দেখাচ্ছে। আমাদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সরকার একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে চলেছে এবং একে গণতন্ত্র বলে চালিয়ে যাচ্ছে।

এবার শাসনতন্ত্র ধ্বংস করা সম্ভব হবে না, এটাই বাস্তবতা। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বরখাস্ত করার ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছিলেন। তিনি আজ নেই। তার সমান উঁচু মাপের নেতা দাবি করার মতোও কেউ নেই। আমরা মনে করি, বিরোধী দলকে পার্লামেন্টে ভূমিকা পালন করতে না দেয়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন করে না। জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বহীন পার্লামেন্টকে শাসনতন্ত্রসম্মত বলার সুযোগ নেই। এর নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

সরকারের মধ্যকার অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতাকে বড় দুর্বলতা হিসেবে না দেখার উৎসাহ এভাবেই ইতিপূর্বে পেয়েছে। যে সুপ্রিমকোর্টের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল সরকার অন্যান্য শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা উপেক্ষা করে চলেছে, এখন সেই সরকার উচ্চতম আদালতের বিচারপতিদের বরখাস্ত করার ক্ষমতাও চাইছে। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টকে বিচারপতিদের বিচারের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তারা ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। বিচার করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে হাউস অব লর্ডসকে। আমাদের পার্লামেন্ট যেহেতু এককক্ষবিশিষ্ট, তাই পার্লামেন্টের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বিচার করার ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই।

তাই ভাবি, কী রাজনীতির জন্য এ দেশের লোক সংগ্রাম করেছে আর এখন কী রাজনীতি তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

সুপ্রিমকোর্ট তার নিজের অস্তিত্বের ইতি ঘটাতে চাইতে পারে না, এ ব্যাপারে শাসনতন্ত্রের শক্তি তার পক্ষে রয়েছে। সাধারণ মানুষের শক্তি ও আস্থা তাদের পক্ষে রয়েছে। তাই বাংলাদেশ বিচারবিহীন দেশ হবে না।

যদি সরকারের নির্বাচনী বৈধতা সুপ্রিমকোর্টকে নির্ধারণ করতে বলা হয়, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সরকার কোথায় গিয়ে শেষ পর্যন্ত থামবে সেটা কেউ জানে না।

ভুলটি সুপ্রিমকোর্টই প্রথমে করেছিলেন, যখন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি একজনের সংখ্যাধিক্যে সরকারকে নির্বাচনের সময়ে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ দেন। কোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট ভেঙে না দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা চিন্তা করা যায় না। এ রকম একটি দৃষ্টান্তও রায়ে উল্লেখ করা হয়নি।

এখন ক্ষমতা হস্তান্তর করার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা চিন্তাও করা যায় না। একটা বিতর্কযোগ্য রায় দিয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছে ভুল বার্তা প্রেরণ করা হয়েছিল। যদি গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে আজ অথবা কাল এ ভুল সুপ্রিমকোর্টকেই শুধরে নিতে হবে।

আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে; কিন্তু বিদ্যমান শাসনতন্ত্রের অধীনে আস্থায় নেয়ার মতো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই।

ইতিমধ্যে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে, যা উদ্ভূত হয়েছে মানবাধিকারের সংকট থেকে। মানুষ অসহায়। পুলিশ অথবা দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো কর্মকর্তা যদি কাউকে গ্রেফতার করে তবে তার সহজে জামিন পাওয়া হবে সৌভাগ্যের ব্যাপার। পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তাকে জেল খাটতে হবে না- তা হতে পারে না। এটাই আমাদের বিচার ব্যবস্থার চিন্তাভাবনা। চাপ তো আছেই। নিছক গ্রেফতার হওয়া মানে সাজা ভোগ করা নয়; কিন্তু তাকে ভোগ করতে হবে। জামিন পাওয়া না-পাওয়া বিচার নয়। নির্দোষ ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণের সহজ ব্যবস্থা।

আইনজীবী যদি কারও পক্ষে জামিন প্রার্থনা করেন তবে কিছু জজ সাহেব ধারণা করেন, তিনি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা দিচ্ছেন। এভাবে জামিনের বিষয়টিকে বিচারে সাজা পাওয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে।

রাজনৈতিক আনুগত্য পোষণকারী পুলিশকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিশ্বাস করা যায় না। তারা সন্দেহের বশে একজনকে অপরাধী বলে গ্রেফতার করতে পারে। গ্রেফতার হওয়ার পর সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি কোর্টের হেফাজতে থাকবে এবং কোর্ট স্বাধীনভাবে বিচার করবে অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যিই অপরাধ করেছে কিনা। এ ক্ষেত্রে আইনের দৃষ্টিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনের আবেদনকে দেখতে হবে নিরপরাধ ব্যক্তির আবেদন হিসেবে। যদি না তার বিরুদ্ধে পূর্বেকার তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রমাণ করা যায়, সে সমাজের জন্য বিপজ্জনক।

পুলিশ শাসিত রাষ্ট্র না হলে তার বিচার ব্যবস্থার চরিত্র অবশ্যই ভিন্ন ধরনের হবে এবং সে ব্যবস্থায় আসামিকে নিরপরাধ হিসেবেই দেখা হবে যতক্ষণ না বিচারে সে দোষী সাব্যস্ত হয়। তাকে বিনা জামিনে এবং বিনা বিচারে আটক রাখার বিষয়টি পুলিশের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ব্যাপার হতে পারে না। কিন্তু পুলিশ মনে করে, তারা যাকে অভিযুক্ত হিসেবে ধরে এনেছে সে অপরাধী।

অভিযুক্তকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে পুলিশ ও জজের মধ্যে পার্থক্য থাকা চাই। পুলিশের ভাষ্য এবং জজের মতামত অভিন্ন হতে পারে না। অভিযোগ তো অপরাধের প্রমাণ নয়।

কেবল কোর্ট নয়, প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য পুলিশকে তার কর্তব্য পালনে সাহায্য করা; কিন্তু সেটা কোনোভাবেই আত্মপক্ষ সমর্থনের মৌলিক অধিকার বিসর্জন দিয়ে নয়। আইনের দৃষ্টিতে নিরপরাধী এ ধারণা জলাঞ্জলি দিয়েও নয়।

অভিযুক্ত ব্যক্তি নিরপরাধ, কোর্টের এ নীতি অভিযুক্তকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থাও বাড়িয়ে দেয়। নিরপরাধীদের সুরক্ষা দিয়েই কোর্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে ছাড় দেয়ার অর্থ কোর্টের নিজেরই ক্ষতিসাধন করা। বিচারপতিরা নির্বাচিত নন সত্য; কিন্তু তাদের ওপর জনগণের আস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন।

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন

আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

 

http://www.jugantor.com/window/2017/05/30/128558/