জমির সংকট, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগে দীর্ঘসূত্রতা ও বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমছেই; তিন মাসের ব্যবধানে বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
২৯ মে ২০১৭, সোমবার, ১২:১৪

শুধু সস্তাশ্রমে বিনিয়োগ আসছে না

বাংলাদেশে সস্তা শ্রমের গল্প শুনিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকরীদের আকৃষ্ট করলেও নানা অবকাঠামোগত বাধা আর বিনিয়োগ পরিবেশের ঘাটতির কারণে তাদের ফিরে যেতে সময় লাগছে না। এতে দেশে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আসছে না।
সস্তা শ্রম আর ইউরোপে জিএসপি সুবিধার লোভে বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসলেও জমির সংকট, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাই চীন, জাপান, সউদী আরব ও ভারতের ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ করছেন না। চীন ও জাপান ইতোমধ্যে ইআরডি’কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগে করতে গিয়ে তাদের উদ্যোক্তারা কি কি বাধার সম্মুখিন হচ্ছেন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের (বিডা) হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশি বিনিয়োগে চরম মন্দার পাশাপাশি দেশি বিনিয়োগেও সাড়া নেই।
জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশে ২০টি শতভাগ বিদেশি ও ২১টি যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে। তারা সাত হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে, যা আগের তিন মাসের তুলনায় ৩৮ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা কম। অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে মোট ৪৩টি প্রতিষ্ঠান ৪৫ হাজার ৭২৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করেছিল। তিন মাসের ব্যবধানেই বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৫০৬ শতাংশ।
একই অবস্থা স্থানীয় বিনিয়োগে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মোট ৫১০টি প্রতিষ্ঠান ৩৭ হাজার ২১৭ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন করিয়েছে, যা গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের চেয়ে ৩১ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা কম। ওই সময় দেশে ৪৮৭টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা।
বিডা’র হিসাবে দেখা গেছে, তিন মাসেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৬৯ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
‘আস্থার সংকট থাকায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না’ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর শিল্পঋণ বিতরণে মন্থর গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।”
রপ্তানিকারকদের সংগঠন ইএবি’র সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অবশ্যই গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দিতে হবে। এ মুহূর্তে একজন শিল্পপতিও গ্যাস পাচ্ছেন না। বিদ্যুতের সংযোগ পেতেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তাই উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।”
“দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসে দেশি বিনিয়োগের গতি দেখে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ না করলে বিদেশিরা সেদেশে বিনিয়োগে আসে না”- বলেন সাবেক এই বিজিএমইএ সভাপতি।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের বাধা চিহ্নিত করে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) প্রতিবেদন দিয়েছে চীন ও জাপান। চীন যেসব বাধা চিহ্নিত করেছে সেগুলো হলো: অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ সংযোগ ও গ্যাস সংযোগ পেতে দীর্ঘসূত্রিতা, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকা।
জমি অধিগ্রহণে জটিলতার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে একই জমির মালিকানা দাবি করেন একাধিক ব্যক্তি। এছাড়া জমির উচ্চমূল্য, অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমিও নিচু এলাকায় হওয়ার বলা হয়েছে এতে। অন্য বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে, কাঁচামাল আমদানিতে বেশি শুল্ক ও কাস্টম ক্লিয়ারেন্স পেতে দীর্ঘ সময় লাগা।
বিনিয়োগ বাধার বিষয়ে জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনও একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা বাধাগুলো হলো- শিল্প ও সেবাখাতে বিদেশি বিনিয়োগের আইন-কানুন ও অবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকা; ইউডি না দেয়ার মাধ্যমে বিজিএমইএ দ্বারা পোশাক খাতে বিনিয়োগে পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ; কেন্দ্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন ও বিধি-বিধান ইংরেজিতে রূপান্তর না করা; বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা না থাকা; জমির ধরন ও মালিকানা নির্ণয়ে জটিলতা; বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন পেতে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর জটিলতা; স্থানীয় বাজারে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ডে ‘বিক্রয় মূল্য’র নিবন্ধন জটিলতা; চলতি মূলধন জোগাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা; বৈদেশিক মুদ্রায় অ-বাণিজ্যিক রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধা; বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থায় স্থানীয় বাজারে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা না থাকা; বাজার মূল্যের সঙ্গে তুলনা করে শুল্কারোপ করা, যা প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি; স্থানীয় জনবল নিয়োগে বাধ্যবাধকতা এবং পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদার) আইন কার্যকর না হওয়া। ওই প্রতিবেদনে জমি নিবন্ধন জটিলতাকে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকাকে প্রধান বাধা হিসেবে মনে করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সহজীকরণ, সহযোগিতা, বাস্তবায়ন ও বৈষম্য দূরীকরণ’- এ পাঁচটি ইস্যুকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইইউ। তাদের মতে, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছতে হলে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে। নতুবা বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে না।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইইউ’র পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত সংস্থাটির রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন বলেছেন, ‘ইইউ মনে করে, ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি না হওয়া।’
এদিকে বিডা একটি গবেষণায় বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ ও জমি নিবন্ধনে বাংলাদেশে দীর্ঘসূত্রিতার একটি তুলনামূলক চিত্র দেখিয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে সময় লাগে ৪৩০ দিন। অথচ অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল দেশ ভিয়েতনামে লাগে মাত্র ৪৬ দিন।
বিডার ওই প্রতিবেদনে প্রতিবেশী ১৭টি এশিয়ান দেশের বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার সময় তুলে ধরা হয়। এতে দেখানো হয়: বাংলাদেশে সময় লাগে ৪৩০ দিন, ভুটানে ৬১ দিন, কম্বোডিয়ায় ১৭৯ দিন, চীনে ১৪৩ দিন, হংকংয়ে ২৭ দিন, ভারতে ৪৫ দিন, ইন্দোনেশিয়ায় ৫৮ দিন, লাওসে ১৩৪ দিন, মালয়েশিয়ায় ৩১ দিন, নেপালে ৭০ দিন, পাকিস্তানে ১৮১ দিন, ফিলিপাইনে ৪২ দিন, সিঙ্গাপুরে ৩০ দিন, শ্রীলঙ্কায় ১০০ দিন, থাইল্যান্ডে ৩৭ দিন, কোরিয়ায় ১৮ দিন এবং ভিয়েতনামে ৪৬ দিন।
বিডার গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সম্পত্তি নিবন্ধনে দীর্ঘসূত্রিতার তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ব্যবসার শুরুতে সম্পত্তি নিবন্ধনে সময় লাগে ২৪৪ দিন। অথচ এশিয়া মহাদেশের অন্য দেশ সিঙ্গাপুরে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে চারদিন; কোরিয়াতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে ছয় দিন এবং ভুটানে সময় লাগে ৭৭ দিন। এছাড়া নিউজিল্যান্ডে একই কাজ সম্পন্ন করতে সময় লাগে মাত্র এক দিন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক ধারা প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “নেতিবাচক বিনিয়োগের বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ ইঙ্গিত। এর সঙ্গে জড়িত প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। টানা কয়েক বছর পর্যন্ত বিনিয়োগ কমছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও বিষয়টি স্বীকার করা হচ্ছে।”
“বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজির পাচার বাড়তে পারে। কারণ কেউ টাকা ফেলে রাখে না।”
কী করলে বিনিয়োগ বাড়বে- জানতে চাইলে শীর্ষ ব্যবসায়ী আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “জাতীয় গ্রিডে যখন বিদ্যুৎ জমা হবে তখন শিল্প খাতে ৪০ শতাংশ দেয়ার পলিসি গ্রহণ করতে হবে। শিল্প স্থাপন করলে গ্যাস পাবে এ রকম নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাহলে যেসব উদ্যোক্তা বিনিয়োগের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত তারা বিনিয়োগ করবেন। আর দেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করলে বিদেশি বিনিয়োগও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আসবে।”

https://www.dailyinqilab.com/article/81545