২৯ মে ২০১৭, সোমবার, ১২:০৮

পদ্মা সেতুতে শুরু থেকেই রেল চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা

পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে সময়মতো রেললাইন নির্মাণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। চীনের প্রতিশ্রুত ঋণের টাকা না পাওয়ায় কাজ শুরু হচ্ছে না। তাই মূল কাজ এ বছরই শুরু করার সম্ভাবনা কম।
সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। প্রথম দিন থেকে সেতু দিয়ে রেল চালুরও ঘোষণা দিয়েছে সরকার। মূল সেতুর কাজ জোরেশোরে চলছে। কিন্তু দুপাশে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। এখন চলছে জমি অধিগ্রহণের কাজ।


পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। দুটি দেশের সরকারের (জি টু জি) মধ্যে বন্দোবস্ত পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ ও চীন সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রেলপথ, সেতু, স্টেশনসহ মূল স্থাপনা নির্মাণে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় চীনের এক্সিম ব্যাংক। চলতি বছরেই অর্থ ছাড় করার কথা ছিল। অন্যদিকে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, পরামর্শক নিয়োগ, শুল্ক ও ভ্যাট—সবই সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের কাজ এগিয়ে চলেছে।


অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনের অর্থায়নের শর্ত হচ্ছে, ওই দেশেরই ঠিকাদার কাজটি বাস্তবায়ন করবে। গত বছরের আগস্টে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ঠিকাদারকে চুক্তির ২০ শতাংশ অগ্রিম অর্থ দেওয়ার পরই মূল কাজ শুরু করা হবে এমন শর্তে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। চীনের অর্থ পাওয়া যাবে—এটা ধরে নিয়ে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল কাজের জন্য বরাদ্দও রেখেছিল। কিন্তু এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি হয়নি। ফলে টাকাও পাওয়া যায়নি। অথচ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা করেছিল, এক্সিম ব্যাংকের টাকা পেলে রাজস্ব থেকে টাকা যোগ করে কাজ শুরুর জন্য ঠিকাদারকে অগ্রিম অর্থ দেওয়া হবে। কিন্তু চীনের অর্থ না পাওয়ার কারণে সরকারের রাজস্ব থেকে যে অর্থ ধরা হয়েছিল, তা-ও ব্যয় করা যায়নি। এ কারণে মূল কাজ শুরু হয়নি।
জানতে চাইলে পদ্মা সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক সুকুমার ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের কাজ পুরোদমে চলছে। ঋণ চুক্তি হয়নি বলে মূল কাজের টাকা পাওয়া যায়নি। তাঁদের সব প্রস্তুতি আছে, ঠিকাদারও আছে, এখন অর্থ পেলেই মূল কাজ শুরু হবে। যত তাড়াতাড়ি অর্থ পাওয়া যাবে, কাজও শেষ করা যাবে তত তাড়াতাড়ি।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে সাড়ে চার বছর সময় ধরা হয়েছে। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চীনের একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন রেলেরই কেউ কেউ। কিন্তু তা আর করা হয়নি। দীর্ঘ এই রেলপথ নির্মাণের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে না—এই বিবেচনায় কাজ শুরুর আগেই পরিকল্পনা কাটছাঁট করা হয়। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথ আগে নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর অংশও রয়েছে। এ কাজের জন্য সময় ধরা হয় আড়াই বছর। কিন্তু এখন অর্থায়ন জটিলতার কারণে এটাও সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন রেলের কর্মকর্তারা।


প্রকল্পের নথি থেকে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর দুই পারে রেললাইন নির্মাণের কাজ চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার পথ হবে মিশ্র গেজের, দুই লাইনের। গেন্ডারিয়া থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন। এই অংশে প্রচুর নদী-জলাশয় থাকার কারণে রেললাইন হবে উড়ালপথে। ব্রডগেজ লাইনের তৃতীয় অংশ মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত। আর ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত চতুর্থ ভাগ সবচেয়ে লম্বা, ৮৭ কিলোমিটার। এই অংশও হবে ব্রডগেজ।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, পুরো ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথে ১৪টি নতুন রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান ছয়টি রেলস্টেশন আধুনিকায়ন করার কথা রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে ছোট-বড় ৩১১টি সেতু ও ৩০টি রেলক্রসিং নির্মাণ এবং সংকেতব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের অধীনে ১০০টি ব্রডগেজ বগি কেনার ব্যবস্থা রয়েছে।
অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ২৭ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকার। শুল্ক-ভ্যাট বাদে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা চীনের। চীনা এক্সিম ব্যাংকের নীতি অনুসারে, বৈদেশিক সহায়তা অংশের ১৫ শতাংশ চীনা সরকার সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে দেয়। বাকি ৮৫ শতাংশ ওই দেশ থেকে পণ্য ক্রয়ের শর্তে দেওয়া হয়। কিন্তু চীন এখন এই নীতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা চায় মূল কাজের ব্যয়ের যে ১৫ শতাংশ চীন সরকারের সহজ শর্তে দেওয়ার কথা, তা বাংলাদেশ সরকার বহন করুক। এ কারণে প্রকল্পের অর্থায়ন আটকে আছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, এই জটিলতা এড়ানোর জন্য গত মার্চে বাংলাদেশে চীনের দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলরের সঙ্গে রেলমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ইআরডির কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। তবে কোনো সুরাহা হয়নি। এরপরই রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনকে জানিয়ে দেয়, চলতি অর্থবছরে তাদের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা খরচ করা যাবে না।


চলতি অর্থবছরে রেলের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এর ৩৭ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল শুধু পদ্মা সেতুর রেলসংযোগের জন্য। সরকার বছর শেষে মন্ত্রণালয়ওয়ারি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার নির্ধারণ করে। রেলপথ মন্ত্রণালয় এডিপি বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকবে—এই বিবেচনায় বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের খরচের জন্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ৪ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। তবে চীন অর্থ ছাড় না করার কারণে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ করে গত ২২ মার্চ পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দেয় তারা। চীনের প্রতিশ্রুতি অনুসারে চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পে ২ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা ঋণের অর্থ পাওয়ার কথা ছিল। পাশাপাশি রাজস্ব খাত থেকেও ২ হাজার ৭১ কোটি টাকা রাখা হয়। চীনের ঋণের অর্থ না পাওয়ার কারণে সরকারের অংশও পুরোটা ব্যয় করা যাচ্ছে না। কারণ রাজস্ব খাতের বরাদ্দের ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণের টাকার পরিপূরক হিসেবে ধরা হয়েছিল। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মাত্র ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা খরচের এখতিয়ার আছে। এর সবই জমি অধিগ্রহণ, বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক কাজে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1196871/