২৯ মে ২০১৭, সোমবার, ১১:৩৬

আমানতকারীরা যাবেন কোথায়

ব্যাংকে আমানতের সুদহার ধারাবাহিকভাবে কমছে। মেয়াদি আমানত রেখে এখন ৫ শতাংশের মতো সুদ মিলছে। এর ওপর রয়েছে সুদের ওপর কর। রয়েছে নানা সার্ভিস চার্জ। আমানতকারীদের এমন দুঃসময়ের মধ্যেই কয়েক দিন আগে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যে কমবে সঞ্চয়পত্রের সুদহার। আবার নতুন বাজেটে ব্যাংকে জমানো টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এসব খবরে আগে থেকেই দুশ্চিন্তায় থাকা আমানতকারীরা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে সঞ্চয়ের টাকায় চলেন এমন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসহায় বোধ করছেন। তাদের প্রশ্ন, সব চাপ কি শুধু আমানতকারীর ওপর? বারবার সঞ্চয় নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত হলে তারা যাবেন কোথায়? সংসার চালাবেন কীভাবে?

এদিকে, উদ্বিগ্ন সঞ্চয়কারীদের একটি অংশ এখন সুদহার বাড়ানোর আগেই সাধ্যমতো সঞ্চয়পত্র কিনছেন। কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কেনার দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে। বিক্রির চাপ সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের কর্মকর্তারা হিমশিম খাচ্ছেন।


বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত হিসাবের সংখ্যা প্রায় আট কোটি। আর আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা।

এর অর্ধেকের বেশি মেয়াদি আমানত। সঞ্চয়ী আমানত রয়েছে ২০ শতাংশের মতো। মোট আমানতের মধ্যে বেসরকারি খাতের অংশ ৮৩ শতাংশ। বাকিটা সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের।

গ্রাহকের আমানত থেকে যে মুনাফা আসে, তার ওপর ১০ শতাংশ কর নেয় সরকার। আর টিআইএন না থাকলে কাটা হয় ১৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি আমানত ও ঋণ উভয় হিসাব থেকে বছরে একবার আবগারি শুল্ক বা এক্সাইজ ডিউটি কাটা হয়। ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর কোনো আবগারি শুল্ক নেই। ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর বছরে কর দিতে হয় ১৫০ টাকা। এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির জন্য দিতে হয় ৫০০ টাকা। ১০ লাখ থেকে এক কোটি পর্যন্ত টাকা থাকলে আবগারি শুল্ক এক হাজার ৫০০ টাকা। এরপর এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত সাত হাজার ৫০০ টাকা এবং পাঁচ কোটি টাকার বেশি হলে ১৫ হাজার টাকা কর দিতে হয়। জানা গেছে, আগামী বাজেটে প্রতিটি পর্যায়ে এ কর দ্বিগুণ করা হচ্ছে।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান সমকালকে বলেন, আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলে আমানতকারীদের ওপর চাপ আরও বাড়বে। এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারকে আরও ভাবতে হবে। নতুনভাবে কোনো কর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন সমকালকে বলেন, আমানতকারীরা এত ঠকতে থাকলে সঞ্চয় অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে চলে যাবে। ফলে এ নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে।

দীর্ঘদিনের সরকারি চাকরি শেষে ২০১৫ সালের মার্চে চূড়ান্ত অবসরে যান ঢাকার মানিকনগরের বাসিন্দা আফসার উদ্দিন। পেনশন হিসাবে যে ৪৩ লাখ টাকা পান, তার মধ্যে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন। ব্যাংকে মেয়াদি আমানত হিসেবে রেখেছেন ১৫ লাখ টাকা। বাকি আট লাখ টাকার একটি অংশ নিজের সঞ্চয়ী হিসাবে রেখেছিলেন আপৎকালীন নগদ খরচ মেটাতে। ব্যাংকের সুদহার অনেক কমে যাওয়ায় বেশ বিপাকে পড়েছেন তিনি। আফসার উদ্দিন বলেন, যখন ব্যাংকে আমানত রেখেছিলেন, তখনকার তুলনায় সুদহার অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো এমনিতেই শুল্ক ও বিভিন্ন চার্জের নামে প্রতিবছর সুদের একটি অংশ কেটে নেয়। এখন আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলে তার ওপর চাপ বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলো এখন সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ সঞ্চয় স্কিমেও সুদহার নেমে এসেছে একই পর্যায়ে। অনেক ব্যাংকের সুদহার ৫ শতাংশের কম। আর কোনো কোনো ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের কিছু স্কিমে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদহার ঘোষিত থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই সব স্কিমে টাকা রাখতে গেলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন ব্যাংকাররা। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনেক অভিযোগও এসেছে। আর ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা রাখলে এখন নামমাত্র সুদ পাওয়া যাচ্ছে। গত মার্চে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার কমে ৫ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি রয়েছে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ, অর্থাৎ এখন ব্যাংকে টাকা রেখে প্রকৃতপক্ষে কোনো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না। দুই বছর আগেও আমানতে ব্যাংকগুলোর গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে ছিল ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ব্যাংক আমানতে সুদহারের এ পরিস্থিতি এবং শেয়ারবাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে ১১ দশমিক শূন্য ৪ থেকে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেড়েছে।

গত ২১ মে ঢাকা চেম্বারের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর ঘোষণা দেন। এর পর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ব্যাপক হারে বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। অথচ সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে বাজেটে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ১৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও পরে তা বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তবে অর্থবছর শেষে বিক্রি দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। মূলত ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে শেয়ারবাজারকে বেছে নিতে না পারায় এ রকম হয়েছে। ২০১০ সালে ব্যাপক ধসের ফলে ওই সময়ে অনেকেই পুঁজি হারানোর পর শেয়ারবাজারকে আস্থায় নিতে পারছেন না।

আমানতকারীদের অনেকে বলছেন, ব্যাংকগুলো এখন আমানত না নিতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। একসময় ঋণ নিতে গিয়ে যেভাবে ঘুরতে হতো, এখন আমানত রাখতে গিয়ে অনেকাংশে সে রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। নানা কৌশলে আমানতকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ একসময় আমানত নিতে মানুষের কাছে গিয়ে ধরনা দিতেন ব্যাংকাররা। তখন ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় থেকে সব কর্মীকে আমানত সংগ্রহের একটি বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া হতো। ওই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারা না-পারার ওপর অনেকাংশে তার পদোন্নতি নির্ভর করত।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি খাতের মেঘনা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ নূরুল আমিন সমকালকে বলেন, আশানুরূপ বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় এমনিতেই ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার অনেক কমিয়ে এনেছে। এখন আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলে আমানতকারীরা মনোস্তাত্তি্বক চাপে পড়বেন। এক ধরনের আতঙ্ক থেকে অনেকে ব্যাংকবিমুখ হবেন। ফলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হবে না।

আমানতের সুদহারের নিম্নমুখী প্রবণতা রোধ করার পরামর্শ দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সার্কুলারে বলা হয়, আমানতের সুদের অত্যধিক হ্রাস সঞ্চয় প্রবণতাকে ক্ষুণ্ন করছে এবং সঞ্চয়ের বদলে অপচয়মূলক ভোগ ও অন্যান্য অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের প্রবণতার ঝুঁকি বাড়ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দায় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। এমন প্রেক্ষাপটে ঋণের সুদ নিম্নগামী ধারায় রাখার জন্য ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়সহ ব্যবস্থাপনা দক্ষতার বিভিন্ন দিকে নজর রেখে স্প্রেড কমাতে বলা হয়। তবে এ পরামর্শ তেমন কোনো কাজে আসেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সুদহার কমে যাওয়ায় আমানতে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মার্চে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১২ দশমিক ২১ শতাংশ; তিন মাস আগে গত ডিসেম্বরে যা ১৩ দশমিক ১৩ ছিল। গত সেপ্টেম্বরে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর গত জুনে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।

http://bangla.samakal.net/2017/05/29/296572