২৯ মে ২০১৭, সোমবার, ১১:৩৫

রোজায় বন্ধ স্কুল যেন কোচিং সেন্টার

কোচিং ব্যবসায় এবার নেমে পড়েছে খোদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই। ভালো ফল অর্জনের নামে 'বিশেষ ক্লাস' হিসেবে খোদ বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়েই করানো হচ্ছে কোচিং। ক্ষেত্র বিশেষে অভিভাবকদের এই 'বিশেষ ক্লাস' করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। সব স্কুল-কলেজই এই কোচিং ক্লাসকে বাধ্যতামূলক করেছে। বিশেষ করে পঞ্চম, অষ্টম এবং দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিজ বিদ্যালয়েই এ ধরনের ক্লাসে বাধ্য করা হচ্ছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১২ সালের 'কোচিং বন্ধের নীতিমালা' অনুসারে, অভিভাবকদের সম্মতি ব্যতিরেকে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা যাবে না বলে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। বাস্তবে এ নির্দেশনার কোনো প্রতিপালন নেই।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয়েই কোচিং করতে বাধ্য করছে। চলতি রমজান মাসজুড়েও শিক্ষার্থীরা
কোচিং করতে বাধ্য হচ্ছে। ক্লাস টাইমের আগে অথবা পরে টাকার বিনিময়ে কোচিং নিতে হচ্ছে তাদের।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদেরকে অতিরিক্ত ক্লাসের নামে কোচিং সেন্টারে পরিণত করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন অভিভাবকরা। এই বিদ্যালয়ের অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সমকালকে বলেন, আইডিয়াল স্কুলটি একটি বড় কোচিং সেন্টারে পরিণত হয়েছে। স্কুলের অধ্যক্ষ গত বছর ৩০ এপ্রিল নোটিশ জারি করে বলেছেন, কোনো শিক্ষকই নিজ বাসায় বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থী পড়াতে পারবেন না। পরবর্তী সময়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের নামে স্কুলে রুম বরাদ্দ দেন। ফলে ওই শিক্ষকরা তাদের নামে বরাদ্দকৃত রুমে রাত ৮টা পর্যন্ত নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যান। জিয়াউল কবির দুলু বলেন, গতবার ১ মে থেকে পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ১২ দিন অতিরিক্ত ক্লাস করানো হয়। এ জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি ১২০০ টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু টাকা আদায়ের কোনো রশিদ দেওয়া হয়নি বা এ সংক্রান্ত কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও করা হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী টাকা আদায়ের রশিদ দেওয়া ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে হিসাব রাখা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া গতবার রমজান মাসেও ৮ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত ৫ম, ৮ম, ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস বাধ্যতামূলক চালু রাখা হয়। এ বছরও গতবারের মতোই একইভাবে কোচিং করানো হচ্ছে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইডিয়াল স্কুলের মতিঝিল শাখায় মোট ৫৬টি রুম বিভিন্ন শিক্ষকদের নামে কোচিংয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যান্য ক্যাম্পাসেও কোচিংয়ে জড়িত শিক্ষকদের নামে রুম বরাদ্দ করে কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিষয়টির ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছে অভিভাবক ফোরাম।
শিক্ষকদের নামে বিদ্যালয়ের কক্ষ বরাদ্দ :কোচিং করানোর জন্য বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষকদের নামে রুম বরাদ্দ করা হয়েছে। যাদের নামে রুম বরাদ্দ করা হয়েছে তারা হলেন নিজামউদ্দিন কামাল-(ইংরেজি) রুম-৫০৬, রফিকুল ইসলাম (সমাজ) রুম-২১৬, শফিকুর রহমান (গণিত) রুম-৪০২, আজিজুর রহমান (বাংলা) রুম-৫০৭, মাকসুদা আক্তার (৫ম শ্রেণি পর্যন্ত) রুম-২০৭, ওয়াহিদুজ্জামান (বাংলা) রুম-২১১, উম্মে সালমা (৫ম শ্রেণি পর্যন্ত) রুম-৫০৯, সুবাস চন্দ্র্র পোদ্দার (গণিত) রুম-৪০১, নুরুল আমিন-২ (গণিত) রুম-৩০৬, লাভলী (৫ম শ্রেণি পর্যন্ত) রুম-২০৬, আবদুস সালাম খান (ইংরেজি) রুম-২১৪, লুৎফা (কম্পিউটার) রুম-৪০৩, রঞ্জন বাড়ৈ (আর্ট) রুম-২০৮, ফখর উদ্দিন (রসায়ন) রুম-৩১৬, খায়রুল ইসলাম (ধর্ম) রুম-২১৭, আবুল কালাম আজাদ (ইংরেজি) রুম-১১৬, গোলাম মোস্তফা (গণিত)- রুম-৩০৮, আলী নেওয়াজ (গণিত) রুম-৪০৮, আলী মুর্তজা (বাংলা) রুম-৪০৬, ফিদা হোসেন (৫ম শ্রেণি পর্যন্ত) রুম-৫০৪,সাখাওয়াত হোসেন (বাংলা) রুম-২০৯, গৌরাঙ্গ চন্দ্র (জীববিজ্ঞান) রুম-৩০৪, মো. সেলিম রুম-২০৪. আবু তাহের (ধর্ম) রুম-৪০৯, সামসুজ্জোহা পেনু (ইংরেজি) রুম-৫১৭ এবং সমীর কৃষ্ণ রুম-২১১।


এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম সমকালকে বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের ভালো ফল করানোর জন্য বিদ্যালয়েই অতিরিক্ত বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করলে আপনারা (সাংবাদিকরা) তাকে কোচিং বলছেন, অথচ বিদ্যালয়ের বাইরে যারা বিকল্প বিদ্যালয় খুলে জমজমাট কোচিং ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন, তাদের নিয়ে কিছু লেখেন না। জোর করে কাউকে প্রতিষ্ঠানে কোচিং করানো হয় না বলেও অধ্যক্ষ দাবি করেন।
অন্যদিকে, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়েও পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে কোচিং করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক অভিভাবক। তারা বলেন, একদিন কোচিংয়ে শিক্ষার্থী না গেলে তাকে জরিমানা করা হয়। আবার মনিপুর স্কুলের শিক্ষকদের মালিকানা ও পরিচালনায় প্রতিটি শাখার প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ৫০ গজের মধ্যে গড়ে উঠেছে ১৫-২০টি করে কোচিং সেন্টার। এসব কোচিং সেন্টার স্কুলে ভর্তির শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। অন্যান্য শিক্ষকরা ক্লাসে মনোযোগ না দিয়ে সারাদিন এসব সেন্টারে বিদ্যা ফেরি করেন। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিবছর স্কুল বেতন ও ফি বাড়ানো হচ্ছে। আর এর বোঝা চাপছে সাধারণ অভিভাবকদের ওপর। ২০১২ সালের ভর্তিতে এ স্কুলের অভিভাবকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আদায় করা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েক দফা নির্দেশ দিলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ এখনও তাতে কর্ণপাত করেনি।
পরিদর্শন ও নীরিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মনিপুর স্কুলের ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকরা ব্যাপকভাবে কোচিং ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলের সবক'টি শাখা মিলিয়ে বিদ্যালয়ের ১০০ গজের মধ্যেই ৩০-৩৫টি কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। তদন্তকালে দেখা গেছে, শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান আইডিয়েল কোচিং সেন্টার, জামাল উদ্দিন মডেল কোচিং সেন্টার, রমিজউদ্দিন রুডিমেট কোচিং সেন্টার, আবুল কালাম আজাদ মিরপুর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কোচিং, নুরুল আলম আল হিকমা কোচিং সেন্টার, ফরহাদ হোসেন বৃহস্পতি কোচিং সেন্টার, জাফর আহমেদ আইডিয়াল কোচিং সেন্টার, নুরুল হুদা এমিটি কোচিং সেন্টার এবং হাফিজ উদ্দিন ইকরা কোচিং সেন্টারের সঙ্গে জড়িত। এর বাইরেও ওয়ারা কোচিং সেন্টার, গ্রীন কোচিং সেন্টার,পূর্বাশা কোচিং সেন্টার, উদয়ন কোচিং সেন্টার, সাকসেস কোচিং সেন্টার, ও গ্রামীণ কোচিং সেন্টারের সঙ্গেও এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।


আরও যত প্রতিষ্ঠানে কোচিং :রাজধানীর শান্তিবাগ উচ্চবিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষকরা কোচিং করতে বাধ্য করছেন। এসএসসি পরীক্ষার এখনও প্রায় ১১ মাস দেরি থাকলেও এ পরীক্ষা পুঁজি করে কোচিং চালু করা হয়েছে। প্রতি মাসে মাথাপিছু আদায় করা হচ্ছে ৭৫০ টাকা। আরও অভিযোগ, কেউ কোচিং করতে আগ্রহ না দেখালে তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক এসএম মাইনুদ্দিন প্রিন্স। তবে এই শিক্ষক অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'অভিভাবকদের আবেদনের ভিত্তিতেই কোচিং চালু করা হয়েছে। এর জন্য নামমাত্র ৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।' মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের অভিভাবক নজরুল ইসলাম রনি অভিযোগ করেন,'অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষার জন্য কোচিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে কোচিংয়ের বদলে এর নাম দেওয়া হয়েছে বিশেষ ক্লাস। এর জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি আদায় করা হচ্ছে ৬০০ টাকা।' উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রের অভিভাবক জানান, পঞ্চম শ্রেণির 'প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী'কে পুঁজি করে চালু করা হয়েছে কোচিং। প্রতি মাসে দাবি করা হয়েছে ১২০০ টাকা করে।


জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কোচিং ব্যবস্থা একটা অনৈতিক পদ্ধতি। বিদ্যালয়েই কোচিং করানো আরও বেশি অনৈতিক। এর মানে হলো নিয়মিত ক্লাসে ওই শিক্ষকরা ভালোভাবে পড়ান না। এ ধরনের কোচিং মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে প্রতিবন্ধী করে ফেলেছে। কাজেই এটার বিরুদ্ধে আমাদের নামতেই হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও মনে করেন, শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত লেখাপড়া নিশ্চিত করতে না পারলে এ ধরনের প্রাইভেট-টিউশনি ও কোচিং ব্যবসা মোকাবেলা সম্ভব নয়। তাই ক্লাসরুমের পাঠদান নিশ্চিত করতে অভিভাবদের সচেতনতাও জরুরি।

http://bangla.samakal.net/2017/05/29/296579