২৯ মে ২০১৭, সোমবার, ১১:৩৩

ব্যাংকে টাকা রাখলে লোকসান!

সুদ কমছে সঞ্চয়পত্রেরও * একজন ব্যাংকার হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে উৎস কর ও আবগারী শুল্ক কেটে নেওয়ার পর গ্রাহক ফেরত পাবে ৯৯ হাজার ৯৫৬ টাকা

ব্যাংকে আমানত অস্বাভাবিক হারে কমছে। মূলত সুদের হার কমায় আমানতকারীরা এখন আর ব্যাংকে টাকা রাখতে উত্সাহী হচ্ছেন না। আগামী জুলাই থেকে সরকার আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বসাবে এমন খবরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমানতে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হচ্ছে বলে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়ের বিনিময়ে প্রাপ্ত সুদ মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি হতে হয়। অন্যথায় টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমায় সঞ্চয়কারীকে লোকসান গুণতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাত্ এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমছে সে পরিমাণ সুদও পাচ্ছেন না আমানতকারী। এতে লোকসান হচ্ছে তাদের।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকের সামগ্রিক আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমেছে। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিলো ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ।

আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বসানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন আবগারি শুল্ক বসালে আমানতে ধ্বস নামবে। একজন ব্যাংকার হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, আবগারি শুল্ক বসানোর পর স্থায়ী আমানতে গ্রাহকের মুনাফা তো হবেই না বরং আরো লোকসান হবে। যেমন, এক লাখ টাকার উপর থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারী শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) ধরা হচ্ছে এক হাজার টাকা। সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে মেয়াদ শেষে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে (বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সুদ ১ শতাংশের মতো বেশি) সুদ পাবেন ১ হাজার ১২৫ টাকা। উেস কর হিসাবে এর ১৫ শতাংশ (১৬৯ টাকা) কেটে নেওয়া হবে। আর আবগারী শুল্ক হিসেবে কাটা যাবে ১ হাজার টাকা। অর্থাত্ মোট ১ হাজার ১৬৯ টাকা কেটে নেওয়া হবে। এতে তিন মাস পরে গ্রাহক ফেরত পাবে ৯৯ হাজার ৯৫৬ টাকা। অর্থাত্ তিন মাস টাকা খাটানোর পর লাভের পরিবর্তে নিজের আসল টাকা থেকেই কম পাবেন গ্রাহক। আর মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার ক্ষয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এ লোকসান আরও বেশি।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. জায়েদ বখত ইত্তেফাককে বলেন, ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নিরাপত্তার জন্য রাখেন। তাই তাদের ক্ষেত্রে আবগারী শুল্কের বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে যারা সঞ্চয় থেকে সুদ পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাখেন তাদের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। ড. জায়েদ বখত বলেন, আমাদের সঞ্চয়ের খাত খুব সীমিত—ব্যাংকের আমানত রাখা, সঞ্চয়পত্র কেনা এবং পুঁজিবাজারে খাটানো। সুতরাং যারা খুব বেশি ঝুঁকি নিতে পারবে না, তাদেরকে সঞ্চয়পত্র কিংবা ব্যাংকেই টাকা রাখতে হবে। তবে মূল্যস্ফীতির হার সুদের হারের চেয়ে বেশি হওয়ায় এমনিতেই মানুষ ব্যাংক আমানতের ক্ষেত্রে প্রকৃতঅর্থে কোনো মুনাফাই করতে পারছে না, তার উপর আবগারী শুল্ক বসানো হলে ব্যাংকে টাকা রাখার চাইতে মানুষ ভোগে বেশি ব্যয় করতে চাইবে। সরকার হয়তো সেটাই চাইছে। কারণ এই মুহুর্তে সঞ্চয়ের কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে না। বরং ভোগ ব্যয় বাড়লে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

জানা গেছে, বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে। যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতের সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সাধারণত সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের আমানতের সুদের মধ্যে দুই থেকে এক শতাংশ পার্থক্য থাকতে হয়। সেখানে বাংলাদেশে পার্থক্য অনেক বেশি। এতে সরকারের বাজেট ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে ব্যাংকের আমানতের সুদ কমলেও ব্যাংকের ঋণের সুদ ততোটা কমেনি। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে মন্দঋণ বেশি হওয়ায় তাদেরকে অনেক বেশি সঞ্চিতি রাখতে হয়। আর সেটি রাখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর মুনাফা যেন না কমে সেজন্য তারা ঋণের সুদ কমাচ্ছে না।

এদিকে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় সরকারের বাজেট ব্যয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বিশেষত: সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে বেশি ঋণ নেয় বলে এ ঋণের সুদ মেটাতে গিয়ে সরকারকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০১৬-১৭) সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকতেই অর্থাত্ ১০ মাসে এ খাত থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় বাজেটে সরকারের সুদ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার চাইলে এর চেয়ে কম সুদে ব্যাংক থেকেও টাকা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের বাজেট ব্যয় কমে যাবে।

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/first-page/2017/05/29/198721