২৯ মে ২০১৭, সোমবার, ১০:৩৬

আলোচনায় আসুক নির্বাচন কমিশন

দেখা অদেখা

||সালাহউদ্দিন বাবর||

গণতন্ত্রকে অর্থবহ করার জন্য অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান একান্ত অপরিহার্য। নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তিনটি পক্ষের একটি হলো নির্বাচন কমিশন। কমিশনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তারাই কার্যত নির্বাচন পরিচালনা করে থাকেন। নির্বাচন নিয়ে এতকাল বিভিন্ন ধারণা ও বক্তব্য এসেছে। এসব আলোচনায় সবাই থাকলেও নির্বাচন কমিশন ছিল না। তবে এখন নির্বাচন কমিশনের আলোচনায় আসা উচিত এবং আসতেও শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনের সূত্র ধরে একটি দৈনিক পত্রিকা লিখেছেÑ আগামী বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা রয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত বিধান অনুসারেই কমিশন কর্তৃক এই সময় নির্ধারিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এমন কথাই ভাবছে। নির্বাচনের দ্বিতীয়পক্ষ সরকার বা সরকারি দল এবং তৃতীয়পক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন। তারাও নির্বাচনের ব্যাপারে ইদানীং তৎপর। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে অনেক প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হয়। তার জন্য কমপক্ষে তাদের দু’বছর সময়ের প্রয়োজন। অথচ এখন কিন্তু এতটা সময় নেই। নতুন নির্বাচনের আগে একটি নির্ভুল ও হালনাগাদ ভোটার তালিকা তৈরি করা জরুরি। গোটা দেশব্যাপী এটা এক বিরাট কাজ। নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং ছাপানোর কাজের ব্যবস্থা করতে হয় যথাসময়ে। তা ছাড়া, এবারের একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দিকে দেশী ও বিদেশী পর্যবেক্ষকরা অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের ১০টি নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এসব নির্বাচনের মধ্যে যেগুলো রাজনৈতিক বা দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার একটিও অবাধ, নিরপেক্ষ ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয়নি। পক্ষান্তরে, যেসব জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে, সেগুলো অপেক্ষাকৃত অবাধ নিরপেক্ষ ও অভিযোগমুক্ত হয়েছে। আগামী সাধারণ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে এখন তুমুল বিতর্ক হচ্ছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে। এই বিতর্কের ইতি হয়নি, কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। অর্থাৎ, ২০১৪ সালের মতোই। এখানেই যত শঙ্কা। ২০১৪ সালের সে নির্বাচন আসলে কোনো নির্বাচনই ছিল না। নির্বাচন নিয়ে হয়েছে এক হাস্যকর প্রহসন। অপর দিকে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দাবি জানিয়ে আসছে, অবাধ ভোটের জন্য নির্বাচন সহায়ক একটি সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি নেতৃবৃন্দের যেসব বক্তব্য সংবাদপত্রে এবং অন্যান্য মিডিয়ায় আসছে, সেখানে তারা স্পষ্ট করেই বলছেন নির্বাচনসহায়ক সরকারের কথা। তারা বলছেন যে, এই দাবি আদায়ের জন্য তারা আন্দোলনেও যাবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলছে, আগামী নির্বাচনের জন্য এটা কোনো ইস্যু হবে না। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সব বিবেচনায় নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে সেটা একটা বড় ইস্যু।
এটা কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ব্যক্তি দল গোষ্ঠীর অভিমত বড় বিষয় হতে পারে না। প্রায় অর্ধশতাব্দী পথপরিক্রমার পরও বাংলাদেশে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ‘সিস্টেম’ তৈরি হয়নি। যে দিকেই লক্ষ করা হোক, সব ক্ষেত্রে সব কিছুই অগোছালো। এ নিয়ে রাজনীতিকদের কোনো ভাবনাও নেই। তবে সম্প্রতি দেশের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য এবং উন্নয়ন সম্পর্কে প্রধান দুই দল ‘ভিশন’ সংবলিত দুটি দলিল প্রস্তুত করেছে। জাতি এ নিয়ে তখনই আশাবাদী হয়ে উঠবে, যখন তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের কর্মসূচি নেয়া হবে। এটা যেন এমন না হয় যে, প্রতিটি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, সে নির্বাচন শেষ হলে তার আর কোনো খবর থাকবে না। পবিত্র পুস্তকের মতো যতœ করে তা তুলে রাখা হয়। এই ‘ভিশন’ নিয়ে যেন এমন না হয়, সে অনুরোধ রইল। দুই প্রধান দলের ‘ভিশন’ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার জন্য আগামী নির্বাচন একটি বড় বিষয় হয়ে দেখা দেবে। উভয় দল ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে হবে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কিছুর ওপর ভরসা না করে কেবল জনগণের ওপর আস্থা রাখা চাই।
বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র জনরায়ের প্রতিই যেন আস্থা থাকে। নির্বাচনের আগে ও পরে আর কোনো বিষয় নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। জাতি যাতে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে, তেমন পূর্বাভাস এখনই যেন তারা পেতে পারে। দেশে দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির আরো উপলব্ধি করা উচিত, অদূর ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের পর আর কোনো অনাকাক্সিত কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না। এতে দেশে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। যারাই জনগণের পছন্দে ক্ষমতায় বসবেন, তারা যেন একটি অনুকূল পরিবেশে কাজ করতে পারেন এবং তাদের ‘ভিশন’ বাস্তবায়নে ব্রতী হতে পারে।
জাতীয় একটি নির্বাচনের জন্য কমপক্ষে দু’বছর সময় লাগে। প্রস্তুতি হিসেবে নির্বাচন কমিশনের হাতে সময় ততটা নেই। তাই তাদের এখনই দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে। আর তারা যে কাজ করছেন সে সম্পর্কে জনগণ অবহিত থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমই এই কাজ করবে। আমরা লক্ষ করছি, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক তৎপরতার কিছু খবর প্রকাশ পাচ্ছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান পক্ষ নির্বাচন কমিশন। অবাধ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে রয়েছেÑ ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে...।’ নির্বাচনকালীন যথেষ্ট ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান দিয়েছে। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে রয়েছেÑ ‘এই ভাগের অধীন নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ এ ছাড়া ১২৬ অনুচ্ছেদে রয়েছেÑ ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি দেশে তো বটেই, একই সাথে আন্তর্জাতিক বলয়েও এই দাবি রয়েছে। এ সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা হলোÑ ‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায় জাতিসঙ্ঘ।’ জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজরিক এই মন্তব্য করেছেন।
সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা স্বয়ং দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রধান হিসেবে তার এই বক্তব্য প্রদানের অর্থ হচ্ছে, জাতির কাছে একটা অঙ্গীকার করা। তবে একই সাথে হতাশ হতে হয় আওয়ামী লীগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার বক্তব্যের কারণে। তারা হামেশাই বলে থাকেন, ‘আগামীতে আমরাই ক্ষমতায় আসব। আওয়ামী লীগের পর পর চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে হবে।’ এখানে ‘জনগণ চাইলে’ কথাটি না বলায় এটা একটা কর্তৃত্ববাদী বক্তব্য বলে মনে হয়। গণতন্ত্রের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এটা যদি তারা কথার কথা হিসেবে বলে থাকেন, তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি প্রকৃত অর্থেই বলে থাকেন, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত। যদি ক্ষমতাসীনেরা আসলেই এটা মনে করেন, তাহলে আর নির্বাচন কেন? এমন ধারার বক্তব্য তো স্মরণ করিয়ে দেয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রহসনমূলক নির্বাচনের কথা। এমন একটি নির্বাচন তো জাতি আশা করে না মোটেও। আর তাতে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। তার প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়বে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা আগেই বলা হয়েছে।
এই গুরুত্বের কারণে দেশের সংবিধান তাদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী করেছে। কিন্তু অতীতে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচন কমিশন সেই স্বাধীনতা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রয়োগ করে নিজেদের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বের দ্বারা জাতিকে কখনোই প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন উপহার দিতে পারেনি। বর্তমান কমিশনের অব্যবহিত আগে যারা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন তারা চরম ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বিদায় নিয়েছেন। একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারার মধ্যেই কমিশনের সাফল্য। বিগত কমিশন সে সাফল্য দেখাতে পারেননি। তাদের অধীনে পাঁচ বছরে যতগুলো জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটি মানোত্তীর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। এসব নির্বাচনে হাজারো অনিয়মসহ নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। এতে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ বজায় থাকেনি। ফলে দেশের পুরো গণতান্ত্রিকব্যবস্থা সম্পর্কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এসব নির্বাচনে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে।
ভাবমর্যাদাহীন, ব্যর্থ, জনগণের আস্থাহীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন এখন দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থা থেকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর দায়িত্ব পড়েছে হালে কমিশনের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের ওপর। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং কমিশনকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে বহু চেষ্টাই তাদের করতে হবে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এবং কিছু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে বর্তমান কমিশনের। কুমিল্লা সিটি নির্বাচন নিয়ে কোনো গোলযোগ বা অনিয়ম হয়নি বটে, তবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কমিশনের শুভ যাত্রা শুরু হয়েছে, এমনটা বলার অবকাশ নেই। তবে এখনই হতাশ না হয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং নয়া কমিশনকে আরো সময় দিতে হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন আগামী একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে তাদের কর্মধারার একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছেন। সহসা তারা এর আলোকে কাজ শুরু করবেন বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। কমিশনের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিশনের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। একই সাথে কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে, তাদের কোনো বক্তব্য বা আচরণ যাতে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না করে এবং তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ না ওঠে। তারা একটি ভঙ্গুর ও বিবর্ণ অতীত নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তাদের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার শুভসূচনা হোকÑ এটা সব মহলের অভিপ্রায়। সত্যিই দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ঐতিহাসিক সূচনার দায়িত্ব বর্তেছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। এ কথা কারো ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের কল্যাণ আমাদেরকেই শুরু করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ এসে তা করে দেবে না।
খবরে প্রকাশ, ২০১৮ সালের নভেম্বর বা ডিসেম্বরে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পরিকল্পনা নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের রোডম্যাপের খসড়া চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। এ ছাড়া নির্বাচনী আইন সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপের আয়োজন আগামী জুলাই মাসে নির্ধারিত করা হয়েছে রোডম্যাপে। এতে আরো স্থান পেয়েছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ডিজিটাল ভোটিং মেশিনে (ডিভিএম) বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের উপযোগী করা এবং ভোট গ্রহণের আগে এ বিষয়ে প্রচার চালাতে নানা কর্মসূচি নেয়া হবে। তবে এ পদ্ধতিতে ভোট নেয়ার ক্ষেত্রে বিএনপিসহ অনেক দলের আপত্তি রয়েছে। বহু উন্নত দেশেও এভাবে ভোট নেয়া হয় না। কিছু দেশ এ পদ্ধতিতে ভোট নেয়া শুরু করলেও তা পরে পরিত্যক্ত হয়েছে যৌক্তিক কারণেই। কমিশন দেশে একদফা স্বল্পপরিসরে ইভিএম পদ্ধতির ভোট গ্রহণ শুরু করেছিল। কিন্তু এতে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় অবশ্য বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে এটা চালু করা হবে না। ক্ষমতাসীন দল অবশ্য ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের পক্ষে। দেশের সাধারণ ভোটারদের প্রশ্ন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ে। গোটা দেশে এই পদ্ধতি চালু করার বাস্তব প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে এখনই এই পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনকে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অহেতুক অসম্ভব কিছু নিয়ে নতুন বিতর্কের সূচনা করা মোটেও ঠিক হবে না। একটি বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্য কমিশন যাত্রা শুরু করেছে। এ মুহূর্তে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এবং সব বিতর্ক এড়িয়েই তাদের এগিয়ে যেতে হবে। জাতির আস্থা নেইÑ এমন একটি প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছে কমিশন। দেশের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার বিরাট দায়িত্ব নিয়ে তাদের পথ চলতে হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে নিবন্ধিত দলগুলোর সাথে দুই দফা সংলাপ করবে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে নির্বাচনী আইন-বিধি সংস্কার এবং সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে চলতি বছরের আগস্টে প্রথম দফা আর সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আগামী বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দ্বিতীয় দফা সংলাপের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে যে রোডম্যাপের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, তাতে দলগুলোর সাথে দুই দফা সংলাপের কথা বলা হয়েছে। তবে এসব কার্যক্রমের কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সময় এগিয়ে গেলে ধাপে ধাপে তা সম্পন্ন হবে। নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে ২৩ দফা করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ও বিধি সংশোধন, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটিং মেশিন প্রস্তুতকরণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং নির্বাচনী সরঞ্জামাদি মুদ্রণ।
নির্বাচন কমিশন দুই দফা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সাথে সংলাপে বসবে। এ আলোচনা বৈঠক তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন কমিশন খোলা মনে বৈঠকে বসবে এবং যেসব যৌক্তিক পরামর্শ আসবে তা গ্রহণ করে নেবে। নির্বাচন কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলের বৈঠকের ফলাফল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে। সংলাপে একটি বিষয় যদি উঠে আসে যে, কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে? এই রাজনৈতিক প্রশ্নের জবাব দেয়া কমিশনের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন যে হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন করতে পারবে না, এটা তাদের উপলব্ধি করতে হবে। অতীতের পরিস্থিতি থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কমিশনের একটা নিজস্ব অবস্থান ঠিক করা উচিত। তবে এটা ঠিক যে, নির্বাচন কমিশন সংবিধানের বিধি মোতাবেক কাজ করতে হয় এবং সরকারের অভিপ্রায়কে অবজ্ঞা করতে পারবে না। তবে সরকারের বিপক্ষে যে, বিপুল জনমত তাকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে, অগ্রাহ্য করা যাবে না। এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন বহু দলই রয়েছে যারা দাবি করে আসছেÑ একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সর্বজনগ্রাহ্য একটি নির্বাচনই জাতির প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশা পূরণ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
গত এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে দু’দিনের এক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ঢাকায় তিনি ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, ভবিষ্যতে বিশ্বের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার একটি হচ্ছে উন্নত গণতন্ত্র তথা সুষ্ঠু ও কার্যকর গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের অর্থ এই নয় যে, মেয়াদ শেষে নিছক একটি নির্বাচন। নির্বাচনের সব বৈশিষ্ট্য থাকাই একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্বশর্ত। গণতন্ত্রের যে উপাদান, তার ভেতর নির্বাচন এর প্রধান উপাদান ও প্রাণস্বরূপ। দেশের উন্নয়নই শুধু নয়, উন্নত গণতন্ত্রও অপরিহার্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উন্নত গণতন্ত্রের মারাত্মক সঙ্কট রয়েছে। ক্যামেরন বিশ্বের আর যে দু’টি সঙ্কট বা চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতি এবং সহিংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কটসহ বিপজ্জনক মাত্রার দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রয়েছে। এই তিনটি সমস্যার সমাধান না হলে দেশ তলিয়ে যাবে। গণতন্ত্রের সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। আর দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটছে জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের অবর্তমানে। সেই সাথে রাষ্ট্রে সুশাসনের অভাব। আর দেশে এখন যে উগ্রবাদিতা বিস্তার লাভ করেছে, তার সাথে জড়িত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি এবং সমাজের নৈতিকতার অভাব। সব মিলিয়ে যদি বিবেচনা করা হয়, তবে সুশাসন ও আইনের শাসন না থাকায় বহু সমস্যার সাথে এসব সমস্যাও
বিস্তৃত হচ্ছে। দেশে দুর্নীতির পরিণতি কতটা ভয়াবহ ও ক্ষতিকর হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে, হাওর এলাকায় সাম্প্রতিক বিপর্যয়। দুর্নীতির কারণে হাওর এলাকার বিভিন্ন বাঁধ ভেঙে গেছে। চরম অবহেলা ও দুর্নীতির ফলে এসব বাঁধ সুষ্ঠু ও টেকসইভাবে তৈরি করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও, সে অর্থ বাঁধ নির্মাণে ব্যয় হয়নি। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের পরতে পরতে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে উগ্রবাদী তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, এই সমস্যার সাথে দেশের মানুষের কোনো সমর্থন ও সম্পর্ক নেই।
বাংলাদেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে জঙ্গিবাদের কোনো সংশ্রব নেই। উগ্রবাদীদের দমনে জাতীয় ঐক্য ও জনসমর্থন সরকার। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ভূমিকা, তা প্রশংসনীয়। উন্নত গণতন্ত্র, দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং উগ্রবাদ মোকাবেলার ক্ষেত্রে দেশের সব সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে এক হতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223801