২৮ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:২২

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

প্রতিকারহীনতায় বিরাজ করছে হতাশা

সমাজের সর্বত্র যেভাবে অবক্ষয় চলছে তাতে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, হতাশা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও। অবক্ষয়ের যে বীভৎস রূপ প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে তাতে এ আতঙ্ক স্বাভাবিক। সম্প্রতি গাজীপুরে বাবা-মেয়ের ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা উল্লেখ করে অনেকে মন্তব্য করেছেন, মনে হয়ে বেশি দিন আর এ সমাজে টিকে থাকা যাবে না। ক্রমেই বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে সমাজ। অপরাধীদের দৌরাত্ম্যে দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। অনেক কিছু থেকেই গুটিয়ে আনতে হচ্ছে নিজেদের। কোথাও যেন আর আস্থা নেই, নিরাপত্তা নেই।
শুধু কি তাই? যাদের এসব দমন করার দায়িত্ব তারাই দেখা যাচ্ছে অপরাধীদের হয়ে কথা বলছে, সাফাই গাইছে। এসব কিভাবে মেনে নেয়া যায় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অনেকে।
সামাজিক অবক্ষয় আর দেশের নানা প্রান্তে তার ভয়ঙ্কর বহিঃপ্রকাশে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে ভীতি আর আতঙ্ক। অনেকে ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। এ থেকে মুক্তির উপায় কীÑ জানতে চাইলে অনেকে বলেছেন, দেশের শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তাদের। এসব অবক্ষয় আর অনাচার দমনে তারা যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে এসব হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া সর্বস্তরে নৈতিকতা চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
জামেয়া কাসেমিয়া কামিল মাদরাসা ও বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ কামালুদ্দীন জাফরী বলেন, সামাজিক অবক্ষয়সহ যেসব বিপর্যয় আর নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে তা রোধ করার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের। বর্তমান সমাজ কাঠামোতে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালন করার সবচেয়ে কার্যকরী শক্তি হলো রাষ্ট্রশক্তি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তারা যদি এ দিকে মনোযোগী হতেন তাহলে সমাজে এভাবে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ত না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী। বর্তমানে সংসদের স্পিকারও একজন নারী। দেশে নারীর ক্ষমতায়ন চলছে। শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রসহ বড় বড় অনেক পদে নারী থাকার পরও বর্তমানে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে সব চেয়ে বেশি। শুধু নারী নয়, ছোট ছোট শিশু পর্যন্ত রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ নামের কিছু হিংস্র পশুর হাত থেকে। কামালুদ্দীন জাফরী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সমাজে যেভাবে অবক্ষয় বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ছে তাতে আমরা ভীষণভাবে চিন্তিত। কোন দিকে ধাবিত করা হচ্ছে আমাদের ছেলে মেয়েদের। অবক্ষয় রোধে দায়িত্ব পালনে শুধু যে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তা নয়, পরিবারগুলোও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে কামালুদ্দীন জাফরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে দমন-পীড়ন আর ক্ষমতায় কিভাবে টিকে থাকা যায় তাকে কেন্দ্র করে। রাজনীতি শুধু একদিকে আবদ্ধ থাকায় এবং একমুখী হওয়ায় সমাজের সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অবাধে যে যার মতো সবকিছু করে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিনোদনের নামে টেলিভিশনে যা খুশি তাই দেখানো হচ্ছে। ভারতীয় টিভি চ্যানেল অবাধে জটিল, কুটিল ও আমাদের প্রচলিত সংস্কৃতিবিরোধী অনুষ্ঠান চলতে দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে কি অশ্লীলতা আর নোংরামি সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে না। এসব নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিকসেবীরা ঘোর আপত্তি তুললেও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।
ভারতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে ধর্ষণ আর যৌন অনাচার। সেই ভারতের সংস্কৃতি অবাধে বিস্তার ঘটানো হচ্ছে আমাদের সমাজে। এর ফল ভয়াবহ হতে বাধ্য।
শিক্ষাব্যবস্থার গলদ তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ ছেলেমেয়েদের কী শেখানো হয়। মুসলিম চেতনা সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না। এসবের সাথে ছেলেমেয়েদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে না সঠিকভাবে। এর কোনো অনুশীলন নেই তাদের মধ্যে; বরং এসব চেতনা হরণ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. শাহ এহসান হাবীব বলেন, অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে আমাদের সমাজে। অন্যায় অপরাধ সহনীয় হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। অনিয়মই নিয়ম হিসেবে মেনে নিচ্ছে সবাই। অনিয়ম সামাজিকীকরণ হচ্ছে। এর কারণ হলো চার দিকে এমনভাবে-অন্যায় অনিয়ম ছড়িয়ে পড়েছে যে, এ থেকে বাঁচার কোনো পথ পাচ্ছে না মানুষ। বিভিন্ন ক্ষেত্র বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে উঠে গেছে জবাবদিহিতা। কমে গেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ। জোর যার মুল্লুক তার নীতি চলছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস এবং অকার্যকর করে ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। আদর্শ রাষ্ট্রে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম চলে তা দেখা যাচ্ছে না। সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা লক্ষণীয়। ফলে অনেকে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। কারণ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে নিরাপত্তা লাভ করা যায়। এর বাইরে বিপুুল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে গরিব মানুষের নিরাপত্তা আর থাকছে না। তাদের বিপদে পাশে দাঁড়ায় না। তার সর্বশেষ নজির হলো সমাজের কাছে ধর্ষণের প্রতিকার না পেয়ে গাজীপুরে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে বাবা-মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন মাত্র। তিনি বলেন, যেসব ভয়ঙ্কর আর মর্মান্তিক ঘটনা আমরা দিনের পর দিন দেখছি তা আর সহ্য করার মতো নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা কেউই যার যা করণীয় তা করছি না। ফলে সর্বত্র বিপর্যয় আর বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজে ছড়িয়ে পড়া অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে হলে সরকার থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত সবাইকে যার যা করণীয় তা করতে হবে। সবাই সবার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা অনেক সময় কোনো একটি সমস্যার সমাধানে যেসব করণীয় নির্ধারণ করি তাতে গলদ থাকে। চলমান অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে হলে নৈতিকতা চর্চার দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই বলে মনে করেন আবুল কালাম আজাদ। শিক্ষাব্যবস্থার গলদ তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষা হতে হবে মানোন্নয়ন ফলাফল, সংখ্যাকেন্দ্রিক নয়। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে হবে প্রকৃত মানুষ তৈরি করা শুধু চাকরিমূলক। সনদ পাওয়া নয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223573