২৮ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:১৮

বিশ্বে মোটা চালের দাম বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি

মোটা চালের দাম বিশ্বে এখন বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। এরপরই আছে পাকিস্তান, তাও বাংলাদেশের চেয়ে ১০ টাকা কম। সরকারি হিসাবেই দেশে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায়। চালের এই দরও দেশের মধ্যে নতুন রেকর্ড।

চালের দাম পর্যবেক্ষণকারী সরকারি তিনটি সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে চালের দাম বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক মাসে মোটা চালের দর বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর গত এক বছরে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, একের পর এক ভুল নীতি গ্রহণ ও সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে চালের দাম এতটা বেড়েছে।
চালের এই রেকর্ড দর নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চাল সংগ্রহের চুক্তি করতে ভিয়েতনাম থেকে কেবল দেশে এসেছি। এখনই চালের দাম বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’
চালের আন্তর্জাতিক দর
চাল-গমের দামবিষয়ক দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সস্তায় চাল বিক্রি করছে ভিয়েতনাম। সেখানে চালের দাম পড়ে প্রতি কেজি ৩৩ টাকা ৬২ পয়সা।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি কেজি চালের দাম ৩৪ টাকা ৪৩ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৩৭ টাকা ৮১ পয়সা ও পাকিস্তানে ৩৮ টাকা ৫৪ পয়সা। এর বাইরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল উৎপাদনকারী দেশ চীন ও ইন্দোনেশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র চাল উৎপাদন করলেও তারা তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে না। উল্টো তারা কিছু চাল আমদানি করে থাকে। এই হিসেবে সবচেয়ে বেশি দামে বাংলাদেশেই চাল বিক্রি হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দর নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘এগ্রি মার্কেট’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে একমাত্র ভিয়েতনাম ছাড়া বিশ্বের মোটা চাল বিক্রয়কারী সব দেশে চালের দাম বেড়েছে। থাইল্যান্ডে ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ, ভারতে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও পাকিস্তানে প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে।
এফএওর গত এপ্রিল মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিশ্বে চালের উৎপাদন ৬ লাখ টন কমবে। ২০১৬-১৭ সালে
বিশ্বে চাল উৎপাদন হয়েছিল ১৭ কোটি ১৩ লাখ টন। এই অর্থবছরে তা কমে ১৭ কোটি ৭ লাখ টন হতে পারে। ফলে তিন বছর ধরে যেখানে চালের দর ছিল কমতির দিকে, এ বছর তা বাড়তে শুরু করেছে।
দেশেও দামের রেকর্ড
খাদ্যনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) হিসাবে, এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রতি কেজি চালের দর ৩৮ টাকায় উঠেছিল। ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতি কেজি চাল ছিল ৩৬ টাকা। এরপর ২০০৯ সালে ধানের বাম্পার ফলনের পর দেশে চালের দাম কমতে থাকে। ২০১২ সালে প্রতি কেজি চাল ২৬ টাকায় নেমে আসে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর চালের দর আবারও বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালে ৩০ এবং ২০১৫ সালে ৩৩ টাকায় ওঠে চালের দর। ২০১৬ সালে মোটা চালের দর ৩৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যদিও কম দামে চাল পাওয়া ছিল সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।
ইফপ্রির ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড়ে খাদ্যশক্তির (ক্যালরি) ৬৫ শতাংশ আসে চাল বা ভাত থেকে। আর প্রতিদিন তারা খাবারের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করে, তার ২৭ শতাংশ যায় চাল কিনতে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দাম বাড়লে গরিব মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, চালের দাম ৪৮ টাকা হয়ে যাওয়ায় প্রায় ২ কোটি নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তায় মারাত্মক হুমকি তৈরি করবে। এসব পরিবারের দিনের খরচের একটি বড় অংশ চাল কেনা বাবদ যায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের বিপদ বাড়বে। তিনি মনে করেন, কয়েক বছর ধরে সরকারের খাদ্যবিষয়ক পদক্ষেপগুলো যে সঠিক ছিল না, তা এখন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।
কেন বাড়ছে চালের দর
প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও বিশেষজ্ঞদের মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূলত চারটি কারণে মোটা চালের দাম এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। প্রথমত, সরকারি গুদামে চালের মজুত গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত শুক্রবার পর্যন্ত সরকারের চালের মজুত ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার টন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি গুদামে কমপক্ষে ৬ লাখ টন চালের মজুত থাকা উচিত। এর চেয়ে কম মজুত থাকলেই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ান। এবারও তা-ই হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীদের হাতে কী পরিমাণে চাল আছে সেই তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। কেউ চালের বেশি মজুত করল কি না, সেই তথ্য সরকার জানে না। ২০১২ সালে খাদ্য মজুত নিয়ন্ত্রণ আইন করা হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
তৃতীয়ত, দেশে চালের উৎপাদন ও ভোগের কোনো সমন্বিত তথ্য এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে নেই। ২০১৩ সালে বিআইডিএসকে দিয়ে বাংলাদেশে চাল উদ্বৃত্ত আছে কি না সে সম্পর্কে একটি গবেষণা করানো হয়েছিল। ওই গবেষণায় দেশে কোনো উদ্বৃত্ত চাল নেই—এমন কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও দেশ খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত—এই তথ্য তুলে ধরে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানি ও ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসিয়ে চালের আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে দুই বছর ধরে শুধু দেশের উৎপাদন দিয়েই চাহিদা মেটানো হয়েছে।
চতুর্থত, চার বছর ধরে চালের উৎপাদন খরচ ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও কৃষক ভালো দাম পাননি। ফলে প্রতিবছরই চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমেছে। ভালো দাম পাওয়া যায় এমন ফসলের দিকে কৃষক বেশি ঝুঁকে গেছেন। বর্তমানে এশিয়ার চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ সবচেয়ে বেশি। এমনকি ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের বোরো ধানের উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ।
এ ব্যাপারে বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ও চালের উৎপাদন এবং ভোগ নিয়ে করা গবেষণার প্রধান মোহাম্মদ ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন চিন্তায় কেন চাল রপ্তানি হয়েছিল, তা বলতে পারব না। হাওরে ধান মার খাওয়ার পরও চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলে আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এটাও ঠিক হচ্ছে না।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1196066/