২৮ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:০৫

নির্বাচন ২০১৯ : লেভেল প্লেয়িংয়ের জন্য অবিলম্বে জনমত সংগঠিত করুন

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন বাংলাদেশ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আঁতুড় ঘর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ধর্নুভঙ্গ পণ করেছিল আওয়ামী লীগ। তখন বিএনপি প্রথম মেয়াদে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। আর বেগম জিয়া ছিলেন ঐ সরকারের প্রধান মন্ত্রী। সরকারি দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে দেয়। বিএনপি যেমন তত্ত্বাবধায়কের দাবি মেনে না নিতে ছিল বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে তেমনি আওয়ামী লীগও তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ছিল দৃঢ় সংকল্প। অথচ ১৩ নম্বর সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সকলেই ছিল যার যার অবস্থানে অটল। আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলে ইলেকশন করবো, না হয় নির্বাচনও করবো না এবং বাংলার মাটিতে আর কোনো ইলেকশন করতে দেয়া হবে না এবং অবশেষে তারা প্রবল গণআন্দোলনের মাধ্যমে, সারারাত ধরে বোমাবাজি করে এবং খোদ বিএনপি মন্ত্রিসভার ওপরেও পেশি শক্তির জোর খাটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক আদায় করে ছেড়েছিল।
অথচ যে ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে তুলকালাম সৃষ্টি করে সেটি কিন্তু ছিল একটি এলাকাভিত্তিক একটি ছোট্ট ইস্যু। বাংলাদেশের মাগুরা জেলার একটি নির্বাচনী এলাকায় অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে ক্ষমতাশীল দল বিএনপি ব্যাপক কারচুপি করে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এই বিষয়টি হয়তো স্থানীয়ভাবেই সমাধান করা যেত।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেটিও হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। অথচ সেই আওয়ামী লীগই ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অর্থাৎ ১৩ নম্বর সংশোধনী বাতিল করে। ২০১৪ সালে দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেটিও অনুষ্ঠিত হয় দলীয় সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচনে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় এমপি নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের পর আসছে ২০১৯ সাল। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক ৫ বছর পর পর নির্বাচন হতে হবে। সেই হিসাবে আবার দেশে সাধারণ নির্বাচনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। হাতে সময় আছে আর মাত্র ১ বছর ৮ মাস। ফলে স্বাভাবিক কারণেই সরকার জোরেসোরে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তারা জেলায় জেলায় কনফারেন্স করছে, মফস্বলের বিভিন্ন জেলায় কমিটি পুনর্বিন্যাস করছে এবং নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবে বিগত সাড়ে ৮ বছরের কার্যকলাপকে বিশাল অর্জন বলে প্রচার চালাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ নির্বাচনী প্রস্তুতির সবচেয়ে বড় অংশ হলো ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণা চালানো। আওয়ামী লীগ দেশের বড় দু’টি দলের অন্যতম। কাজেই তারা যে জোরেসোরে ইলেকশন ক্যাম্পেইনে নামবে সেটি আর বলার অবকাশ রাখেনা।
অন্যদিকে বিএনপিও পেছনে পড়ে নাই। একজন বিখ্যাত কবি লিখেছেন, “হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।” বিএনপিও আর এবার নির্বাচনের ব্যাপারে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা খেতে রাজি নয়। তারাও লোক চক্ষুর অন্তরালে ব্যাপক নির্বাচনী প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। অবশ্য বিএনপির কোনো কোনো সিনিয়র নেতা বলছেন যে, যদি কোনো সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে তারা সেই ইলেকশনে অংশগ্রহণ করবে। অন্য দুই একজন সিনিয়র নেতা বলছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো অবস্থাতেই তারা নির্বাচনে যাবে না। এর জন্য যদি কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তাহলে তারা তাও করবে। তবে শেষ কথা আসবে দলের অবিসংবাদিত নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নিকট থেকে। এখন পর্যন্ত তিনি এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি।
নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ সম্পর্কে সংগ্রামের এই প্রতিনিধি ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছেন। ঐ অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে সেখান থেকে দেখা যায় যে বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতাই ইলেকশন করার পক্ষে। প্রায় ১০ বছর হলো তারা ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন। এর মধ্যে বিগত সাড়ে ৩ বছর হলো তারা শুধু ক্ষমতার বাইরেই নন, এমনকি সংসদেরও বাইরে। তাই বিএনপির অধিকাংশ নেতা মনে করেন যে, অবাধ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি জনগণের রায় নিয়েই ক্ষমতায় যাবে। আর যদি কোনো কারণে সরকার ব্যাপক সন্ত্রাস ও কারচুপি করে মেজরিটি আদায় করে, তাহলেও বিএনপি সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে অবস্থান করবে। তাই নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতি শতকরা ১০০ ভাগ। ইতোমধ্যেই ৩০০ আসনের বিপরীতে ৯০০ শত প্রার্থী ঠিক করে রাখা হয়েছে। যতই নির্বাচন এগিয়ে আসবে ততই ঐ ৯০০ জনের তালিকা সর্ট লিস্টেড হবে। সর্ট লিস্টেড হতে হতে এক সময় ৩০০ আসনের নমিনেশন পাক্কা হবে।
॥ দুই ॥
অবশ্য এখানে কিছু জটিলতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোটের নেতা হিসেবে বিএনপিকে কৌশলী হতে হবে। ২০ দলের মধ্যে ১৯ দলই দুই একটি করে আসন চাইবে। সকলকে কি একমোডেট করা সম্ভব হবে? এদিকে ২০ দলের বাইরেও কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন করবে বলে জানা গেছে। তাদের সংগঠন বড় হোক বা না হোক, নেতা হিসেবে তারা খুব ওজনদার। ড. কামাল হোসেন ইলেকশন করবেন কিনা সেটি জানিনা। তিনি ইতোমধ্যেই ৮০ বছর পার করেছেন। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন করুন আর না করুন, তার দলের লোকজন ইলেকশন করবে। অন্যদিকে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ বা জেএসডি ইলেশকন করার জন্য মফস্বল পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছেন।
নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি টেলিভিশন টক’শোতে বলেছেন যে, তারা ইলেকশন করতে চান। এজন্য সারা দেশে ১০০ জনেরও বেশি ক্যান্ডিডেট দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন। তিনি এসব টক’শোতে একথাও বলেছেন যে, বিএনপির ইলেকশন করা না করার ওপর নাগরিক ঐক্যের ইলেকশন করা না করা নির্ভরশীল। নাগরিক ঐক্য এখনো সেই অর্থে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠেনি। তবে দেশের কয়েকজন নিরপেক্ষ ও শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী এই দলটিকে পেছন থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদিন মালিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক এবং কয়েকজন সচেতন সাংবাদিক। অন্যদিকে দুটি বামপন্থী দল বিশেষ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বা বাসদও নির্বাচন করতে চায়। অন্যদিকে জেনারেল এরশাদ তো ইলেকশন করার জন্য এক পায়ে খাড়া। এসব দেখে শুনে আমার মনে হয় যে, ইলেকশন শেষ পর্যন্ত হয়ে যাবে।
বিদেশী বন্ধুরা এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করছেন। তাই আওয়ামী সরকারকে চেষ্টা করতে হবে যাতে করে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজিৈনতক দল আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। এই মুহুর্তে বলা যায় যে, এরশাদের জাতীয় পার্টি, রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টি, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম প্রভৃতি দল শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে। তবে বাংলাদেশের তিনটি বৃহত্তম দলের মধ্যে দুইটি বৃহত্তম দল যদি ইলেকশন বয়কট করে তাহলে সেই ইলেকশন কতখানি গ্রহণ যোগ্যতা পাবে সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। দল দুটি হলো বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, জামায়াত তো এবার ইলেকশন করতে পারবে না। কারণ, নির্বাচন কমিশন এই দলটির নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। বাতিল করলেই কি তাদেরকে নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে? জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল সারাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। তাদেরকে ইলেকশনে স্বনামে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না দিলেও তারা ভিন্ন নামে ক্যান্ডিডেট দেবেন। এমন একটি পরিস্থিতিতে নামকে ওয়াস্তে যেসব রাজনৈতিক দল প্রার্থী দেবে তারা দেশের শিক্ষিত সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে মোটেই গ্রহণ যোগ্য হবে না।
॥ তিন ॥
গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক, ২০১৪ সালের মতো সরকার যদি জোর করে একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করেই ফেলে এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০টির বেশি আসন দখল করে তাহলেই বা বিরোধী দলসমূহের করার কি আছে? শুধুমাত্র বিরোধী দলসমূহ বলবো কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরই বা করার কি আছে? ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বিশ্ব সমাজের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ এই নির্বাচন মেনে নেয়নি। কিন্তু তার পরেও সেই নির্বাচন বিশ্ব সমাজের স্বীকৃতি পায়, কারণ জনগণ যে ঐ নির্বাচনের পেছনে নাই এবং জনগণের কাছে যে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হয়নি তেমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারেনি বিরোধী দল। ফলে ধীরে ধীরে হলেও ঐ ইলেকশন গ্রহণ যোগ্যতা পেতে থাকে।
এবারের পরিস্থিতি বিরোধী দলের জন্য আরো খারাপ। তাদের হাজার হাজার কর্মী কারান্তরালে। শত শত নেতা কর্মী রিমান্ডে যেয়ে অসুস্থ। লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মী মামলা নিয়ে পলাতক। পুলিশ র‌্যাব তথা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণভাবে সরকারের কুক্ষিগত। অনেকে এই সব বাহিনীকে আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী বলে আখ্যায়িত করছেন। একদিকে ভারতের অকুন্ঠ সমর্থন অন্যদিকে বিরোধী দলের প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মার মুখো অবস্থান- মাঝখানে গণতন্ত্র চিড়ে চ্যাপটা হয়ে গেছে। এই অবস্থাতে আগামী নির্বাচনে যদি লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হয় অর্থাৎ সরকারি ও বিরোধী দলকে নির্বাচনী তৎপরতা চালানোর জন্য সমান সুযোগ সুবিধা দেয়া না হয় তাহলে ২০১৯ সালের নির্বাচনও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো প্রহসনে পর্যবসিত হবে। তাই বলে কি বিএনপি তথা বিরোধী দল আগামী নির্বাচন বয়কট করবে? সোজা সরল উত্তর হলো না, নির্বাচন বয়কট করা চলবে না। বরং এখনও যে হাতে ১ বছর ৮ মাস সময় রয়েছে এই সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। আন্দোলনকে সহিংস না করেও দুর্বার করা যায়। সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ সবগুলো বিরোধী দল যদি গণগ্রেফতার বরণের জন্য প্রস্তুত হয়, হাজার হাজার মানুষ যদি রাজ পথে নেমে আসে তাহলে ঐ কারচুপি নস্যির মতো উড়ে যাবে।

http://www.dailysangram.com/post/285609-