২৮ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:০৪

অপ্রতিরোধ্য গতিতে

|| আলমগীর মহিউদ্দিন ||


শতাব্দীর অভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রচলিত জ্ঞান ও ধারণা এখন বারবার হোঁচট খাচ্ছে। আবহাওয়ার প্রকৃতি ছকের বাইরে চলে যাচ্ছে। সামাজিক শান্তি ব্যাহত হচ্ছে ঘন ঘন। সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের সংখ্যা সব হিসাবকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। কেন যেন কোনো হিসাবই মিলছে না। আকাক্সাগুলো বৃথা যাচ্ছে, আর বেশির ভাগ আশাই মরীচিকায় পরিণত হচ্ছে। এখন প্রায়ই একটি প্রশ্ন একে অন্যকে করছেÑ এরপর কী? কেন এমন হচ্ছে? তরুণদের চিন্তাশীল অংশকে দেখা যায় বৃদ্ধদের কাছে ছুটতে। অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো দিশা আছে কি না।
তবে এক ুদ্র জনগোষ্ঠী এমনটি ভাবছে না, বরং তাদের বিজয় হচ্ছে বলে মনে করছে। অবশ্য এমন অবস্থা নতুন নয়। পুরনোকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান ও প্রত্যয় সব সময়ই ছিল; কিন্তু সে প্রত্যয় এবং বর্তমান প্রকৃত অবস্থার কোনো মিল নেই।
এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বিশ্বের দু’টি চিন্তাশীল অংশ প্রায় একই ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। তারা হলোÑ যুক্তরাষ্ট্রের নাসা (ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস এজেন্সি) এবং ইউরোপিয়ান সায়েন্স ফাউন্ডেশন (EFF)। তারা বলেছেন, অদৃশ্য বৈরী অবস্থা অপ্রতিহত গতিতে পৃথিবীকে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রকাশ ভিন্ন হলেও বক্তব্য প্রায় একই। তা হলো এ মহাধ্বংস হবে অপরিবর্তনীয়।
নাসা ঠিক তিন বছর আগে তাদের পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে প্রথম এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল। আধুনিক সভ্যতার অব্যাহত ও সীমাহীন ভোগবাদকে সমালোচনা করে প্রয়োজনীয় সম্পদ সীমিত হয়ে পড়ার কথা বলেছে। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্রমবর্ধমান অশান্তির জন্য আধুনিক ভোগবাদকে দায়ী করে। নাসার গডার্ড স্পেস সেন্টার বিশ্ব আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করতে গিয়ে এই ভয়াবহ চিত্র আবিষ্কার করেছে। সম্প্রতি এ সমীক্ষার ওপর নতুন আপডেট দেয়া হয়েছে। তবে বক্তব্য একই। শিল্পোন্নত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, ধনের অসম বণ্টন এবং তাদের বিশাল ভোগকে এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কারণ বলে উল্লেখ করেছে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন এ প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের সঠিক পথ বাতলে দিচ্ছে, তেমনি এর অতি ব্যবহারের পথটিও সহজ করে দিয়েছে। ফলে সমাজে বিশাল বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। প্রযুক্তির অধিকারীরা বিশাল জনগোষ্ঠীর সব অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে এক দিকে যেমন সমাজকে অশান্ত-ভঙ্গুর করে ফেলছে, অপর দিকে তারা এ পরিণতির কথা অস্বীকার করছে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলেছেন, এমন অবস্থা অতীতেও হয়েছে। যেমন রোমানরা বা ভারতের গুপ্তরা যখন প্রযুক্তির অধিকারী হয়ে সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করল, সভ্যতা হারিয়ে গেল তখন। সময়ের ব্যবধানে এ প্রযুক্তির পরিশীলন ঘটেছে এবং এর সাথে সব সম্পদের অতি ব্যবহারও হচ্ছে। ফলে এবারের ধ্বংসের পরিমাপ হবে বৃহত্তর এবং সম্ভবত অপরিবর্তনীয়। নাসা বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলেছেন, ধ্বংসপথের এ গতিকে এখনো নমনীয় করা সম্ভব, যদি শক্তিমানেরা তাদের ভোগের মাত্রা কমান এবং সম্পদের ব্যবহার সবার মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে দেন।
ইএফএফ (ঊঋঋ) বিশ্বের আগ্নেয়গিরিগুলোর ওপর সাধারণভাবে নজর রাখে এবং সম্প্রতি এক অনুসন্ধান রিপোর্টে বলেছে, এগুলো সচল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। হয়তো শতাব্দীর শেষে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে। তারা বলেছেন, এ অগ্ন্যুৎপাতের আকার ভিসুভিয়াসের চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে। ১৮১৫ সালের ইন্দোনেশিয়ার তামবোরা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের উল্লেখ করে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এবারের অগ্ন্যুৎপাত সব সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার ওই অগ্ন্যুৎপাতের লাভা ২৬ মাইল ওপরে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল। ফলে তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষ আর রোগ ও মহামারী দেখা দেয়। উত্তর মেরুর কাছে আইসল্যান্ডের লাকি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে ১৭৮৩ সালে। এটাকে ছোট অগ্ন্যুৎপাত বলেছেন বিজ্ঞানীরা (স্কেল ভিইআই ৫)। কারণ এতে আইসল্যান্ডের তেমন ক্ষতি হয়নি; কিন্তু ৯ হাজার ৩৫০ জন লোক মৃত্যুবরণ করে। এর প্রভাবে আফ্রিকার এবং ভারতের আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে এবং বৃষ্টিপাত কম হয়। মিসরে ব্যাপক দুর্ভিক্ষে দেশের ছয় ভাগের একভাগ লোক মারা যায়। ব্রিটেনে ১৭৮৩ সালকে ‘বালির গ্রীষ্ম’ বলে অভিহিত করা হয়। কারণ শ্বাসকষ্টে ২৫ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। ইএফএফ রিপোর্টে বলা হয়, এই অগ্ন্যুৎপাত ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও গালফ অব মেক্সিকোর আবহাওয়ারও অনেক পরিবর্তন ঘটায় এবং সে বছরকে ‘গ্রীষ্মহীন বছর’ বলা হয়। এই আগ্নেয়গিরিটি মাঝে মধ্যেই লাভা উদগিরণ করছে। সবশেষ, ২০১০ সালে এমনটি হয়েছে। তখন সারা ইউরোপ ও আমেরিকায় বিমান চলাচল বিঘিœত হয় এবং নানা প্রকার রোগ-মহামারী বিস্তার লাভ করে।
ইএফএফ দাবি করেছে, বিশ্বের মানুষ এখনো এ ভয়ানক সম্ভাবনার কথা নিয়ে ভাবছে না। আর ক্ষমতাবানেরা বলছেন, এই অগ্ন্যুৎপাতের ফল এত ব্যাপক হবে, তাই তার প্রতিবিধানের জন্য অর্থ ব্যয় করে কোনো লাভ হবে না। তাহলে কি বিশ্ব তার শেষ অবস্থার দিকেই যাচ্ছে? কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, এমন অবস্থা প্রতি ৪৫-৭০ হাজার বছর পর পর গত ২০ লাখ বছর ধরে ঘটছে। তখন বিশ্ব প্রায়ই প্রাণিশূন্য হয়ে যায়।
বিশ্বের ভয়ঙ্কর অবস্থার ব্যাপারে সতর্কবাণী সাধারণত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেই এসে থাকে। বহু বছর ধরে নানা স্তরে এ বার্তা এসেছেÑ যেহেতু সেসব বার্তার মূল বক্তব্য ক্ষমতা। তাই জনগণের কাছে সত্যিকারের চিত্র ভেসে ওঠেনি। এখনো তার ব্যত্যয় ঘটছে না। পশ্চিমা বিশ্বেই এর অনুসন্ধান ও আলোচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এটা স্বাভাবিক এ জন্য যে, গত পাঁচ শতাব্দী ধরে পশ্চিমা শক্তিবর্গ দুনিয়াকে শাসন করছে। ১৪৯২ সালে মুসলিম শক্তি স্পেনে পরাজিত হওয়ার পর তারা কখনোই ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি। আধুনিক প্রযুক্তির জন্মদাতা তারা হলেও এর মানববিরোধী কর্মকাণ্ডে তারা যুক্ত হওয়ার আগেই পরাজয় বরণ করেছে। এই মানব ও মানবতাবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড ব্যতিরেকে সাম্রাজ্য গঠন এবং তার পরিবর্ধন খুব কঠিন। তাই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এর প্রায় একক ব্যবহার করছে। তবে সব দোষ চাপাচ্ছে এবং এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী করছে ভুক্তভোগীদের, যাদের প্রায় সবাই মুসলমান।
আজকের যুগ প্রচারে বন্দী। সত্য প্রায়ই অর্গলবদ্ধ। তার ছিটেফোঁটা কিছুটা মুক্তি পেলে, তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রচারকর্মীরা ‘হত্যা করে’। ফলে মুসলমানরা বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে ‘বিভীষিকাময় জন্তু’। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। টিভি কথক ও ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক কার্ল গ্যালাপ তার বহুল প্রচারিত বই ‘ফাইনাল ওয়ার্নিং আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য ট্রামপেট ডেজ অ্যান্ড রিভিলেশন’-এ বলেছেন, শেষ যুদ্ধের জন্য পাঁচটি ভেরি ধ্বনিত হয়েছে। ষষ্ঠ ভেরিধ্বনি যেকোনো সময়ে সম্ভব। তিনি বাইবেলের রিভিলেশন ২:১৩ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘শয়তানের আবাসস্থলে’ এ যুদ্ধ হবে, যেখানে ২০ কোটি মানুষ হবে বিজড়িত। এই এলাকাটি হবে ইউফ্রেটিস নদীর এলাকায়। এখন এ নদী তুরস্কে জন্মলাভ করে সিরিয়া-ইরাকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। তাহলে এটাই কি শয়তানের আবাসস্থল, অবশ্য কার্লের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমানের হানাহানি এ এলাকাতেই হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এ যুদ্ধে ইরান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, উত্তর আফ্রিকা এবং সম্ভবত চীন জড়িয়ে পড়বে এবং এটা হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে যদি আণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়, তাহলে বিশ্বে মানবজাতি আবার নিশ্চিহ্ন হবে এবং এ যুদ্ধে আণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হবেই। তাহলে কোথায় হবে? অবশ্যই সংঘর্ষের ক্ষেত্রে যা এখন শুধু মুসলিম এলাকায়। যারা প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সূচনা, পরিচালনা এবং শেষ করে তাদের অনেকেই জীবিত। এবার তারা যুদ্ধটি মুসলিম বিশ্বে যাতে হয় এর কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত। এরা সবাই পশ্চিমা রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী। পশ্চিমা প্রচারবিদ ও লেখকেরা এ ধারণাকে উৎসাহ দান করেন। যেমন সাংবাদিক লিও হফম্যান বিরামহীন মুসলিমবিরোধী প্রচারের পরে লিখলেন, ‘স্টিলথ ইনভেশন : মুসলিম কনকুয়েস্ট থ্রু ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট জিহাদ’, বইটির নামেই বোঝা যায় এর ভেতরের বক্তব্য। মুসলমানরা পশ্চিমা বিশ্ব দখল করবে অভিবাসনের মধ্য দিয়ে এবং এ কথা সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করা হয়েছে। এ কথাটি এখন অসম্ভব কল্পনার ফানুস মনে হলেও একজন সাদা আমেরিকানের কাছে বিশ্বাসযোগ্য যখন সে তার অতীতের দিকে দৃকপাত করে। তখন তারা স্বল্পসংখ্যক অভিবাসী হয়েও বিপুল স্থানীয়কে নির্মূল করেছিল। তবে বর্তমানে অভিবাসীদের যে অবস্থা, তাতে এমন কল্পনাও অসম্ভব।
গত পাঁচ শতাব্দীর সব যুদ্ধ, সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ডের মূল খলনায়ক ও সঞ্চালক পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ। উদাহরণ হিসেবে ব্রিটিশ ও মার্কিন দখলদারির কথা উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক জ্যাক ডি ডগলাস। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যার এই অধ্যাপক তার বহুল পঠিত ‘আমেরিকান ম্যাসাকার হ্যাভ বিন কমন ফর সেঞ্চুরিজ’ নিবন্ধে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মার্কিন সৈন্যরা ভাবে, তারা যেকোনো হত্যাকাণ্ড-সংঘর্ষ ঘটাতে পারে, যদি না তা বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়।’ এ জন্য বিশ্বের সব অন্যায়-কর্মকাণ্ডের সত্যিকার সামগ্রিক চিত্র যাতে প্রকাশ না পায়, তার বিশেষ চেষ্টা চলে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার নো গুন রি হত্যাকাণ্ড। সেখানে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হলেও খবরটি চেপে রাখা হয়। তবে লেফটেন্যান্ট ক্যালির মাই লাই হত্যাকাণ্ডের ছবি ও ঘটনা প্রকাশ পেলে কর্মকর্তারা, ডগলাসের ভাষায়, এক ‘সুইট হার্ট শো’ বিচার করেন। ক্যালি নিজ হাতে ৫০০ ভিয়েতনামি শিশু-নারীকে হত্যা করেছিল। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলেও তিন বছর পর মুক্তি পেয়ে যায়। ডগলাস লিখেছেন, ‘ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে বোমার আঘাতে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, তবে তাদের কথা পশ্চিমা বা বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে কখনো আসে না। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে চলছে ধ্বংস ও মৃত্যুর বিরামহীন কর্মকাণ্ড যা নিয়ে কোনো আমেরিকানকে কখনো চোখের পলকও ফেলতে দেখা যায় না।’ অধ্যাপক ডগলাস দুঃখ প্রকাশ করেছেন, অনেক মার্কিন লেখকের কাছে ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন এক আনন্দ উদযাপনের বিষয়। উদাহরণ হিসেবে অধ্যাপক ডগলাস উল্লেখ করেছেন মার্কিন সামরিক ঐতিহাসিক ভিকটর ডেভিড হানসনের ‘কালচার অ্যান্ড কারেজ’ বইটির কথা। এ বইতে ইরাক-আফগানিস্তানে দেড় যুগের হত্যা-ধ্বংস-অনাচারের এমনভাবে বর্ণনা দেয়া রয়েছে, যেন আনন্দের বিষয়। ‘আমি এমন নৃশংস হত্যা ও ধ্বংসের কথা লিখতাম আনন্দ উদযাপন না করে। তবে আমি তো সংখ্যালঘিষ্ঠের দলে এ ব্যাপারে’ তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী ট্রেজারি সেক্রেটারি ড. পল ক্রেইগ রবার্টস ‘অ্যা গভর্নমেন্ট অব মোরনস’ (জড়বুদ্ধি সরকার) প্রবন্ধে বর্তমান সময়ের অবস্থার ওপর মন্তব্য করেছেন, ‘এখন সত্য যে বলছে, (ক্ষমতাবান ও সরকারগুলো) তাকে দৈত্য-অপদেবতা হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে।’ তিনি সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ও লেবাননের ধ্বংসযজ্ঞের সাথে নতুন করে উত্তর কোরিয়া আক্রমণের সম্ভাবনার কথা বলে মন্তব্য করেছেন, এটা হবে তৃতীয় মহাযুদ্ধ, যা মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। তাই তিনি যারা এমন যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে, তাদের ‘জড়বুদ্ধি সরকার’ বলেছেন। উল্লেখ করেছেন, এমন জড়বুদ্ধি ক্ষমতাবানেরা অতীতের বিশ্বযুদ্ধসহ সব সঙ্ঘাত-হত্যাযজ্ঞের প্রণেতা। তারা ভাবে, মানুষ হত্যা বা রাজ্য দখল করলেই তারা চিরকালের জন্য সুখে থাকবে। কিন্তু হিটলার-মুসোলিনিসহ সব যুদ্ধবাজ বিজয়কে উপভোগ করার সময় পায়নি। কিন্তু তারা মানবজাতির ক্ষতি করে গেছে। যেমন সম্প্রতি মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, ‘রাশিয়াকে শাস্তি না দিলে, দেশ (আমেরিকা) সামনে এগোতে পারবে না। কারণ তারা (রাশিয়া) আমাদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে।’ অর্থাৎ তিনি রাশিয়ার সাথে একটি যুদ্ধ চাইছেন। একজন সমালোচক এর ওপর মন্তব্য করেছেন, ‘তাহলে রাশিয়া এত শক্তিশালী যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকেও প্রভাবিত করতে পারে?’
এ দিকে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ম্যাড (মিউচ্যুয়ালি অ্যাস্যুয়র্ড ডেসস্ট্র্রাকশন) টু ম্যাডনেস (পাগলামি)’ বইতে, পল জনস্টোন লিখেছেন, যুদ্ধের জন্য যে গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভর করা হয়, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল, মিথ্যা ও অবাস্তব এটা বিশ্বের সব দেশের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ গোয়েন্দা তথ্যের নামে ক্ষমতাবান বা সরকার যা করে, তার ভিত্তি খুবই দুর্বল। গোয়েন্দারা ‘বস’ যা চান তেমন তথ্যই তৈরি করে। জনস্টোন সারা জীবন কাটিয়েছেন মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ারে। অবসরে তার স্মৃতিকথা লিখেছেন এ বইতে। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত এই বইতে একটি মোক্ষম কথা বলেছেন। ‘ক্ষমতাবান এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কে কাকে ব্যবহার করছে তার হিসাব জটিল। তবে তারা প্রায়ই নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে যুদ্ধ, অশান্তি এবং ষড়যন্ত্র চায়।’ তার ভয়ানক ফল ভোগ করে সবাই, এমনকি তারাও। এখন তারা একটি যুদ্ধ চাইছে। এটা কি শেষ যুদ্ধ হবে, প্রশ্ন করছে অনেকেই।
‘থ্রি ওয়ার্ল্ড ওয়ার’ ডটকম বলে এক সংস্থা মহাযুদ্ধের ক্ষতি ও কারণের এক চমৎকার তথ্যভাণ্ডার সৃষ্টি করেছে। এতে দেখা যায়, ২৮ জুন ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম মহাযুদ্ধে ২৪টি দেশ জড়িত ছিল। যুদ্ধ শেষ হয় ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সালে। ১,১০,১৬০০০ লোক মৃত্যুবরণ করে এতে। ক্ষতির পরিমাণ ১৯৬.৫ বিলিয়ন ডলার। আর্থার বালফুর, বেনিটো মুসোলিনি, ডেভিড লয়েড জর্জ, কিং ফার্ডিনান্ড ও কিং পিটারসহ ৭৯ জন নেতা যুদ্ধ শুরু, পরিচালনা ও শেষ করেছিলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয় ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ এবং ৬৫টি দেশ জড়িত ছিল। শেষ হয় ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫। ক্ষতির পরিমাণ ২০৯১.৩ বিলিয়ন ডলার এবং পাঁচ কোটি ৯০ লাখ ২৮ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। হিটলার, বেনিটো মুসোলিনি, চিয়াং কাইশেক, চার্লস দ্য গল, কিমেন্ট অ্যাটলি, সম্রাট হিরোহিতো, জর্জ ম্যানডেল, হ্যারি ট্রুম্যান, জন ফস্টার ডালেসসহ ৭৩ জন নেতা যুদ্ধ শুরু, পরিচালনা ও শেষ করেন।
সংস্থাটি বলছে, এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এটা শুরু হয়েছে ২০ মার্চ ২০০৩। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ওপর আক্রমণের ৫৫৫ দিন পরে এবং ৫৭ বছর ৮ মাস ১৮ দিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ও ৮৮ বছর ৮ মাস ১৩ দিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল রাশিয়ার জারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। যুদ্ধ শেষে রাশিয়া সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও একই উদ্দেশ্যে। তবে এবার রাশিয়াতে কমিউনিস্ট শাসন আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক আলবার্ট পাইক বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এখানে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ করা হয়েছে। ১৮৭০ সালে এক ইহুদি পাদ্রি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে ইহুদি রাষ্ট্র এবং মুসলমানদের মধ্যে। অথচ তখনো ইহুদিবাদ বা জিয়নিজমের সৃষ্টি হয়নি এবং ইসরাইলের কল্পনাও ছিল না। অর্থাৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অতি পুরনো। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে নানা নামে বর্ণনা করা হচ্ছে। প্রধান নাম ‘ওয়ার অন টেরোরিজম’ (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ)। এর প্রধান লক্ষ্য মুসলিম দেশগুলো। এই যুদ্ধে দুই লাখ ৫১ হাজার লোক মারা গেছে বলে এ সমীক্ষা দাবি করেছে। এ যুদ্ধের জন্য তালেবান, বাথ, হিজবুল্লাহ, আলকায়েদা, ওয়াজিরিস্তান ট্রাইব, আইএসআইএস, আবু সাইফসহ নানা সংগঠনের জন্ম দেয়া হয়েছে। যুদ্ধগুলো চলছে প্রধানত তেলসমৃদ্ধ মুসলিম এলাকায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ১৫ বছরের এ সন্ত্রাসের কারণে শুধু ইরাকেই মারা গেছে ১৪ লাখ লোক। সত্যিকারের সংখ্যা আরো বেশি বলে দাবি করেছেন অনুসন্ধানীরা। তারা বলেছেন, আসলে সন্ত্রাসের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরাই সৃষ্টি করে এ সংস্থাগুলো।
অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের ৯টি দেশে ২০ হাজার ১৬৮টি আণবিক বোমা আছে। সেগুলো হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র (১০ হাজার ৪৫৫), রাশিয়া (৮ হাজার ৪০০), চীন (৪০০), ফ্রান্স (৩৫০), ইসরাইল (২৫০), ব্রিটেন (২০০), ভারত (৬৫), পাকিস্তান (৪০), উত্তর কোরিয়া (৮)। এ হিসাব ২০০৮ সালের। এর মাঝে সংখ্যা আরো বেড়েছে।
যুদ্ধবাজদের পরিকল্পনা এবং ক্ষমতার সত্যিকারের ছবি কখনোই প্রকাশিত হয় না। যুদ্ধ হলে তা বোঝা যায়। তখন জনগণের যন্ত্রণাই হয় মুখ্য। তবে এখন অনুভব করা সম্ভব যে, এরা সমরাস্ত্রের বিপুল সমাহার ঘটিয়েছে এবং তার ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব। যদি তারা এসব ব্যবহার করতে পারে, মহাধ্বংসের বর্ণনা দেয়ার কেউ থাকবে না। অতীতের ‘ম্যাড’ চুক্তি তাদের কিছুটা নিরস্ত্র করেছিল; কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে নতুন পরিবর্তনের পরে এই যুদ্ধবাজেরা আবার নড়াচড়া শুরু করেছে। ফলে বিশ্ব অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে শেষ অঙ্কে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223513