২৭ মে ২০১৭, শনিবার, ১১:৪৬

হিমায়িত মৎস্য রফতানি হুমকির মুখে

অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রফতানি পণ্য চিংড়ি ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোর উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সময় মতো ডেলিভারি না দিতে পারলে বহির্বিশ্বে মুখ থুবড়ে পড়বে হিমায়িত মৎস্যখাত। তাই জেনারেটরেই চলছে হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া। শুধু এই রফতানিখাতই নয়, অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঁধা বিদ্যুৎ বিভ্রাট। তবে কবে নাগাদ লোডশেডিংয়ের হাত থেকে মুক্তি মিলবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, একটি মুহূর্তও বিদ্যুৎ বিহীন চলে না হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। চিংড়ি ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণে গড়ে প্রতিদিন দশ থেকে বারো ঘণ্টা জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন সচল রাখার প্রাণবন্ত ও চেষ্টা চালাচ্ছে কারখানাগুলো। ফলে প্রতি ঘণ্টায় হিমায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়তি জ্বালানি তেল খরচ হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ লিটার। উৎপাদন খরচ বাড়লেও এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ পাবে না প্রতিষ্ঠানগুলো। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শতাধিক ছোট-বড় হিমায়িত চিংড়ি ও মৎস্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের চিংড়ি ও মাছ রফতানি হয় বিশ্বের ১৯টি দেশে। কিন্তু অব্যাহত লোডশেডিং ভোগান্তিতে পড়েছে এসব কারখানাগুলো। লোডশেডিংয়ের কারণে মাছের অন্যতম চাহিদা বরফ উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে তাদের। কবে নাগাদ লোডশেডিংয়ের হাত থেকে মুক্তি মিলবে সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ।
খুলনার আছিয়া সী ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তরিফুল ইসলাম জহির বলেন, নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে, পরবর্তীতে আর বায়ার (বিদেশী আমদানিকারকরা) পাবো না। তখন ভোগান্তিতে পড়তে হবে, রফতানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জাতীয় রাজস্ব আয় কমবে, তাতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বাড়তি অর্থ ব্যয়ে জেনারেটর চালিয়ে হলেও উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে হচ্ছে।
ওই প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রদীপ কুমার দে বলেন, সারাদিনে জেনারেটর-ই তো বন্ধ করতে পারছি না। লোডশেডিংয়ের কারণে অতিরিক্ত অর্থ খরচের পাশাপাশি যন্ত্রাংশেও ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
শুধুমাত্র হিমায়িত খাদ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানই নয়, লোডশেডিংয়ে বরফকলগুলোও পড়েছে বিপাকে। বরফ উৎপাদন করতে পারছে না চাহিদামতো। পর্যাপ্ত বরফের অভাবে সংগ্রহ করা মাছ সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ছে।
রফতানিকারকরা বলছেন, বছরে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী এই শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না হলে রফতানি বাধাগ্রস্ত হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম হারাবে। তাই দ্রুত এ অঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি তাদের।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি কাজি আমিনুল হক বলেন, বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক সভ্যতার একটি মুহূর্ত কল্পনা করা যায় না। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, দু’তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। যদি তাই হয়, তাহলে রক্ষা। না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শুধু রফতানি নয় দেশের মানুষ বাঁচানো দায় হয়ে দাঁড়াবে। অবিলম্বে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে ওজোপাডিকো লি. খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবু হাসান বলেন, ‘জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। যা মেরামতের কাজ চলছে। তবে কবে নাগাদ ঠিক হবে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়ছেই : খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্রীষ্মের শুরু থেকেই বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং শুরু হয়েছে। দিনের বেলাসহ সন্ধ্যা নামার পর পরই দফায়-দফায় বিদ্যুতের লুকোচুরি চলছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ৬০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকছে। প্রচন্ড গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়েছে।
ওজোপাডিকো লিমিটেডের সূত্র মতে, গত বুধবার পদ্মার এপাড়ের ২১ জেলায় ওজোপাডিকো ও পল্লী বিদ্যুতে ডে পিক আওয়ারে চাহিদা ছিল ১১৫৭ দশমিক শূন্য ৮ মেগাওয়াট আর সরবরাহ ছিল ৮২২ দশমিক শূন্য ৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল ৩৩৫ দশমিক ১ মেগাওয়াট। আবার পিক আওয়ারে (সন্ধ্যায়) চাহিদা ছিল ১৬০২ মেগাওয়াট আর সরবরাহ ছিল ৯৯৬ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, এখানে লোডশেডিং ছিল ৬০৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট।
ওজোপাডিকো’র সূত্র আরো জানান, বৃহস্পতিবার ২৫ মে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একুশ জেলায় অফপিক আওয়ারে (দিনে) বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ২৪৮ দশমিক ৩ মেগাওয়াট। সেখানে সরবরাহ করা হয়েছে ৮৭৩ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি ছিল ৩৭৪ দশমিক ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর আগের দিন বুধবার একই সময় চাহিদা ছিল ১ হাজার ১৫৭ দশমিক ৮ মেগাওয়াট। সরবরাহ করা হয় ৮২২ দশমিক ৭ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ৩৩৫ দশমিক ১ মেগাওয়াট। তবে পিক আওয়ারের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। ওই দিন পিক আওয়ারে চাহিদা ছিল ১ হাজার ৬০২ মেগাওয়াট, সেখানে সরবরাহ করা হয় ৯৯৬ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ৬০৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। এর আগে গত এক সপ্তাহ ধরে লোডশেডিং’র মাত্রা ছিল আরও ভয়াবহ। তবে বৃহস্পতিবার শহরাঞ্চলে কিছুটা কমলেও পল্লীতে সঙ্কট আগের মতই রয়েছে।
এই সূত্রটি জানান, খুলনার গোয়ালপাড়াস্থ ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ইউটিটের লাইফ টাইম শেষ হওয়ায় সেটি বন্ধ রয়েছে। একই স্থানে অবস্থিত ৬০ মেগাওয়াট ইউনিটটিও অনেক দিন ধরেই বন্ধ। এছাড়াও এ অঞ্চলের আরও কয়েকটি ইউনিট গড়ে প্রতিদিনই বন্ধ থাকে। ফলে ক্ষমতার বিপরীতে উৎপাদন হয়না। এছাড়া উৎপাদনের একটি বড় অংশ জাতীয় গ্রিডে চলে যায়। যে কারণে আপাতত সঙ্কট নিরসনের কোন সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছে সূত্রটি।
খুলনা ও বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একুশ জেলা নিয়ে গঠিত ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)। এ প্রতিষ্ঠানটিই এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু আসন্ন রমযানেও চাহিদার বিপরীতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারে তারা কোন সু-খবর দিতে পারছে না।

http://www.dailysangram.com/post/285509-