২৭ মে ২০১৭, শনিবার, ১১:৪৫

পর্যাপ্ত মজুদ তবুও বাড়ছে পণ্যমূল্য

দেশে প্রতি বছর চিনির চাহিদা ১৫ থেকে ১৬ লাখ মেট্টিক টন। তবে রমজান মাসে চাহিদা থাকে অন্য মাসের তুলনায় বেশি। এ মাসে চিনির প্রয়োজন হয় আড়াই লাখ টনের মতো। দেশে বর্তমানে চার লাখ টনের মতো চিনির মজুদ থাকলেও কেবল রমজানের অজুহাতে দাম বাড়ছে হু হু করে। তিন মাস আগে খুচরা বাজারে যে চিনি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল, একই মানের চিনির দাম কেবল রোজার অজুহাতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৭২ টাকা।
সরকারি হিসেবে দেশে প্রতি বছর ছোলার চাহিদা ৫ থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় রমজান মাসে। সে হিসাবে রমজানে ছোলার চাহিদা আড়াই থেকে তিন লাখ মেট্টিক টন। বিপরীতে দেশে মজুদ আছে তিন লাখ টনেরও বেশি ছোলা। অথচ ছোলার দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তিন মাস আগে যে ছোলা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল, গতকাল তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ টাকায়। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে ব্যবসায়ী নেতারা প্রায় প্রতিদিনই ঘোষণা দিচ্ছেন রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম স্বাভাবিক থাকায় এবং দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও পবিত্র রমজান মাসকে উপলক্ষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় অস্বস্তিতে ভুগছেন দেশের সাধারণ মানুষ। স্বল্প ও নি¤œ আয়ের মানুষ দৈনন্দিন হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, বাজারে সরকারের মনিটরিং না থাকার সুযোগে সুবিধাভোগী অসৎ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নেয়ার সুযোগ নিচ্ছেন। আমদানিকারক, মিলমালিক, পাইকার ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বাজারে এত কিছু হচ্ছে তারপরও সরকারের কোনো তদারকি বা মনিটরিং নেই। এতে অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, ঈগলু, টিকে গ্রুপ, দেশবন্ধু ও এস আলমের মতো আট থেকে দশটি গ্রুপ দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজধানীর শ্যামবাজার, মৌলভী বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও কাওরান বাজারের বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার আশায় বিশাল মজুদ গড়ে তুলেছেন। মজুদদার সিন্ডিকেটে যুক্ত রয়েছেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন আমদানিকারকও। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজার যেমনই থাকুক, রমজান এলে সিন্ডিকেট করে এসব ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। সরকারের উচ্চ মহলে ব্যাপক প্রভাব থাকায় সবকিছু জেনেও মাঠপর্যায়ের প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক মাস আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৪৬ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে ৫২ টাকা হয়েছে। আমদানি খরচ, পরিবহন ও ব্যবসায়ীদের মুনাফাসহ প্রতি কেজি ৭০ টাকা বিক্রি করলেই চলে। কিন্তু বাড়তি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা এর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। একই অবস্থা পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও। এক মাস আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল সাড়ে ৮ টাকা। এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯ টাকা। দেশে এক মাস আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজির দাম ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। ভালো মানের পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে সাধারণ মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। মাঝারি মানের ৩৮ এবং একটু ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক মাস আগে দেশের বাজারে প্রতি কেজি রসুনের দাম ছিল ২১০ থেকে ২৩০ টাকা। নি¤œ মানের কিছু রসুন ছিল ১৫০ টাকা কেজি। বর্তমানে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে নি¤œমানের রসুন ২৩০ টাকায়, ভালো মানের রসুন ২৩০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। এক মাস আগে প্রতি কেজি আদার দাম ছিল ৬০ থেকে ৯০ টাকা। এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। এক মাস আগে বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ছিল ৮২ থেকে ৮৬ টাকা কেজি। এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১০৫ টাকা কেজি দরে। এক মাস আগে নি¤œ মানের মসুর ডালের কেজি ছিল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। খুব ভালো মানের ডালের কেজি ছিল ১৩৫ টাকা। বর্তমানে নি¤œ মানের মসুর ডালের কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা। মাঝারি মানের ডাল ১২০ টাকা এবং ভালো মানের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়।
প্রতি বছরই রমজানের আগে ভোগ্যপণ্যের আমদানি, মজুদ পরিস্থিতি এবং বাজারমূল্য নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন ব্যবসায়ীরা। বরাবরের মতো এবারো কয়েকটি বৈঠক হয়েছে এবং প্রতিটি বৈঠকেই দ্রব্যমূল্য না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বরাবরের মতো এবারো বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা দিয়েছেন, রমজানে যাতে ভোগ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে তার জন্য সরকার সব ধরনের সহায়তা করবে। দাম না বাড়ালে ব্যবসায়ীদের পুরস্কৃত করা হবে। আর যারা দ্রব্যমূল্য বাড়াবেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাস্তবতা হলো, দ্রব্যমূল্য না বাড়াতে এখনো পর্যন্ত সরকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সংবাদও দেশবাসীর চোখে পড়েনি।
এ দিকে রমজানকে উপলক্ষ করে দাম বাড়ানো হয়েছে মাছ, মুরগি, সবজি প্রভৃতিরও। ফার্মের মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে বিভিন্ন ধরনের মাছের দাম। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গরুর গোশতের দাম ৪৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও এ দামে গরুর গোশত মিলছে না। উত্তরাঞ্চলে পরিবহন ধর্মঘটের অজুহাতে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রমজান উপলক্ষে অনেক ক্রেতা একসঙ্গে পুরো মাসের বাজার করায় বাজারের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বেশির ভাগ পণ্যের দাম কমবে বলেও জানান অনেকে। এ ক্ষেত্রে একসঙ্গে পুরো মাসের বাজার করা থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান তারা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223314