২৭ মে ২০১৭, শনিবার, ১১:৪৪

অভিভাবক উদ্বিগ্ন ছেলেশিশু নিয়েও

শুধু মেয়েশিশু বা মেয়েদের নিয়েই নয়, এখন ছেলেশিশু এবং ছেলেদের নিয়েও উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। ছেলে শিশুকে শিক্ষক কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের খবর প্রায়ই শিরোনাম হচ্ছে গণমাধ্যমে। শুধু পাশবিক নির্যাতন নয়, নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রায়ই গ্রেফতার এবং গণধোলাইয়ের শিকার হচ্ছেন নির্যাতক শিক্ষক। 

মুক্তাগাছায় একটি মাদরসায় গত জানুয়ারিতে এক শিশুকে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনা ঘটে। মুক্তাগাছা থানা পুলিশ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয় বলাৎকারের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় শিশুটিকে।
গত মার্চ মাসে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানার সেগুনবাগান তালিমুল কুরআন মাদরাসা থেকে এক শিশু ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি গোপালগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় এক মক্তব শিক্ষককে শিশুর ওপর পাশবিক নির্যাতনের সময় হাতেনাতে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন এলাকাবাসী। শিক্ষক কর্তৃক এভাবে ছেলেশিশু নির্যাতনের খবর প্রায়ই চোখে পড়ছে । শুধু শিক্ষক নন, অন্য বিভিন্ন মাধ্যমেও ছেলেশিশুরা অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে প্রায়ই। এ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে অভিভাবকদের মধ্যে।
ও লেভেলের ছাত্র জুবায়েরের ছিল ফুটবলের প্রতি তীব্র আগ্রহ। রাজধানীর উত্তরা ৪, ৫ ও ৬ নম্বর সেক্টরে কিশোরদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দিতেন আলজেরিয়ান নাগরিক আবু ওবায়েদ কাদের। ফুটবল প্রশিক্ষণের আড়ালে তিনি কিশোরদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে বাসায় নিয়ে তাদের দিয়ে বিকৃত লালসা মেটাতেন। একদিন উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে বিকেলে খেলা শেষে পুকুরে গোসল করতে নামে জুবায়ের। তখন ওবায়েদ কাদেরও সেখানে নামেন এবং সেখানেই তাকে বলাৎকারে উদ্যত হন। জুবায়ের এতে বাধা দেয় এবং ধস্তদস্তির একপর্যায়ে তাকে চুবিয়ে হত্যা করেন ওবায়েদ। বছর দুয়েক আগে উত্তরার এ ঘটনায় সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
পরিবার সমাজ রাষ্ট্রে যেভাবে অবক্ষয় আর বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে তাতে অভিভাবকদের অসতর্ক থাকার কোনো সুযোগ নেই একেবারেই। ছোট শিশুদের যেমন সারাক্ষণ দেখে রাখতে হয় মা-বাবাকে তেমনি স্কুল কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া সন্তানকেও যেন আর এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করা যাচ্ছে না। একটু অসতর্ক হলেই কখন যেন মাথার ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিপদ এসে হাজির হচ্ছে আজকাল। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং তরুণ-তরুণীদের সম্পর্কে যেসব ন্যক্কারজনক খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে তাতে যারপরনাই উদ্বিগ্ন সব শ্রেণীর অভিভাবক। গভীর রাতে গ্রামের মা-বাবাকে কেউ একজন ফোন করে জানাচ্ছেন তার মেয়ে বা ছেলে রাজধানীতে খুনের শিকার হয়েছে। মা-বাবা ছুটে এসে হত্যার কারণ সম্পর্কে এমন সব ঘটনা জানতে পারেন, কারো কাছে মুখ দেখানোর আর উপায় থাকছে না তাদের। এলাকার লোকজনের কাছে মেধাবী ভদ্র হিসেবে পরিচিত এসব তরুণ-তরুণীর অপরাধ জানাজানির পর বিস্ময়ের সৃষ্টি হয় সবার কাছে। একের পর এক এ ধরনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাক্ষী হচ্ছেন দেশবাসী। প্রাণপ্রিয় মেধাবী সন্তান পড়াশুনার আড়ালে যে এভাবে কোন ন্যক্কারজনক ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে পারে তা কখনো চিন্তাও করতে পারেন না অনেক সহজ সরল মা-বাবা। কিন্তু নিকট-অতীতেও এমনটা ছিল না আমাদের এ সমাজ, রাষ্ট্রে। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ সবকিছু যেন রাতারাতি বদলে দিচ্ছে।
রাতারাতি প্রচার পেতে এবং শোবিজ জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে এখন অনেক তরুণ-তরুণী ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে লাইভ হাজির হচ্ছে । চলছে নোংরা প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা। পাগল করে দিচ্ছে তরুণ যুবকদের মনমগজ । ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ বিকৃতি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়াদের কেউ কেউ যোগ দিচ্ছে নীল ছবির জগতে। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে নিষিদ্ধ ব্যবসার জগতে রাতারাতি কড়কড়ে নোট আর উচ্চবিলাসী জীবনের আকাক্সায়। সাথে অনৈতিক বিনোদন তো থাকছেই। এ কাজে শুধু তরুণী নয় জড়িয়ে পড়ছে অনেক তরুণও। ইন্টারনেটের সুবাদে প্রকাশ্যে প্রচার চালিয়ে এ ব্যবসা করছে অনেকে এখন। গড়ে উঠেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। এ বিষয়ে একেবারেই অসেচতন অনেক অভিভাবক।
ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে ফেসবুক টুইট ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
চলতি মাসে যুক্তরাজ্যের একটি সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারের ফলে তরুণ- তরুণীদের মধ্যে মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে অশালীনতা, নিঃসঙ্গতা আর হতাশা। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এ মাধ্যমটি। ১৪ থেকে ২৪ বছরের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে চালানো হয় এ জরিপ। বাংলাদেশেও প্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক নানা অঘটনের খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে।
সন্তান বড় হলে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে রাখা যায় না। আবার বাইরে গেলেও খারাপ পরিবেশ এবং সঙ্গদোষের দুর্ভাবনা। তা ছাড়া প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং মোবাইল ইন্টারনেটের কারণে সন্তান বিপথগামী হওয়ার সব উপাদান এখন তাদের হাতের মুঠোয়। এক সময় মা-বাবার দুশ্চিন্তা ছিল নিরাপত্তা, মাদক, খারাপ বন্ধুবান্ধব ও পরিবেশ থেকে সন্তানকে সন্ত্রাস, বখাটেপনা থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং খারাপ প্রভাব নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব দুশ্চিন্তার মাত্রা। মোবাইল ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক পরিচয়ের সূত্র ধরে অনেক ছেলে-মেয়ের ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া এবং এরপর হত্যা ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির অপব্যবহার কেড়ে নিচ্ছে অনেকে শিক্ষার্থীর মনোযোগ। দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে পড়ালেখায়। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে নানা ধনের অপরাধে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরিবার, আত্মীয়স্বজন সমাজ এবং চারপাশের পরিবেশ থেকে।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন ‘ক্ষেত আর পুত, যতœ না নিলে হয় যমদূত’। সত্যিই সন্তানের প্রতি যত্মবান না হলে মনোযোগী না হলে তা যে মা-বাবা পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য কতবড় কলঙ্ক, ক্ষতি আর বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সারা দেশে অগণিত পরিবার। সাক্ষী হচ্ছেন দেশবাসী।
সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীদের মতে শিশুদের প্রতি যেমন মা-বাবাকে সব সময় যতœবান থাকতে হয়, দেখেশুনে রাখতে হয় তেমনি কিশোর তরুণ যুবক সন্তানদেরও এখন একইভাবে দেখেশুনে রাখতে হবে সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223326