চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার জাতিসংঘ পার্কে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নির্মাণ করা দুটি সুইমিংপুল। প্রায় ২২ মাস ধরে সুইমিংপুল দুটি ও একটি জিমনেসিয়াম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা l জুয়েল শীল
২৭ মে ২০১৭, শনিবার, ১১:৪২

চট্টগ্রামের দুটি সুইমিংপুল কাজে লাগছে না

চার কোটি টাকা গচ্চা, এবার ১২ কোটি টাকার প্রকল্প!

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশের জাতিসংঘ পার্কে সিটি করপোরেশনের নির্মাণ করা দুটি সুইমিংপুল ২২ মাস ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মাত্র একবার সেখানে সাঁতার প্রতিযোগিতা হয়েছে। এখন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, অপরিকল্পিতভাবে সুইমিংপুল দুটি নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামের খোলা মাঠে আরেকটি সুইমিংপুল নির্মাণের কাজ শুরু করছে। খেলার মাঠে সুইমিংপুল নির্মাণ বন্ধ করতে আন্দোলন করছে বিভিন্ন সংগঠন।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, জাতিসংঘ পার্কে সুইমিংপুল থাকবে না। পার্কের উন্নয়নের জন্য ১২ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
জাতিসংঘ পার্কে এক একর জায়গার ওপর দুটি সুইমিংপুলের পাশাপাশি একটি জিমনেসিয়াম ভবনও হয়েছে। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি স্থাপনার নির্মাণকাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালের জুন মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনা দুটি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর মেয়রের পরিবর্তন হলেও দুটি সুইমিংপুল ও জিমনেসিয়াম কোনো কাজে লাগানো হয়নি। উল্টো ২০১৬ সালের জুন মাসে পার্কের মালিকানা নিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের বিরোধ দেখা দেয়।
পার্কে সুইমিংপুল আর জিমনেসিয়ামের পরিবর্তে কৃত্রিম লেক ও হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সাবেক মেয়র মনজুর আলম জাতিসংঘ পার্কে মনগড়া জিমনেসিয়াম ও সুইমিংপুল করেছেন। এ ধরনের অপরিকল্পিত উন্নয়নের বিপক্ষে আমরা।’
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, জাতিসংঘ পার্কে নির্মিত দুটি সুইমিংপুলের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট ও প্রস্থে ৫০ ফুট। এর একটির গভীরতা আট ফুট, আরেকটির সাড়ে আট ফুট। জিমনেসিয়াম ভবনটি সাত হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে। এর ভেতরে শরীরচর্চার কোনো সরঞ্জাম নেই।
অবশ্য চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুর আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৌশলীদের পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পিতভাবেই সুইমিংপুলটি নির্মাণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ঠিক থাকলেও সুইমিংপুল দুটির গভীরতা কিছুটা বেশি। ১২০ ফুট দীর্ঘ সুইমিংপুলের গভীরতা ছয় থেকে সাড়ে ছয় ফুট হয়ে থেকে। করপোরেশন চাইলে সুইমিংপুল দুটি ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে পারত।
চলতি মাসের ৮ মে জাতিসংঘ পার্কে গিয়ে দেখা যায়, সুইমিংপুল ও জিমনেসিয়াম ভবনটি পার্কের এক পাশে। দুটি স্থাপনা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের এক পাশে ফটক রয়েছে। সেটি তালা দেওয়া। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ফটকের বাইরে অপেক্ষা করেও কোনো প্রহরী পাওয়া যায়নি। ফটকের বাইরে থেকে দেখা যায়, দুটি সুইমিংপুলের একটিতে পানি রয়েছে, অন্যটিতে পানি নেই বললেই চলে।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ৫০ বছর আগে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুই একর আয়তনের পার্কটিকে তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করে। এরপর থেকে সিটি করপোরেশন এ পার্কের ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর আ জ ম নাছির উদ্দীন এই পার্ক, জিমনেসিয়াম ও সুইমিংপুল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেন। ২৫ বছরের জন্য ইজারা দিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে করপোরেশন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বাণিজ্যিকভাবে পার্ক ইজারা দেওয়ার এই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানায় গণপূর্ত বিভাগ। গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন তখন সিটি মেয়রের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
সিটি করপোরেশন চার কোটি টাকা খরচের পর এখন আবার জাতিসংঘ পার্কে নতুন উন্নয়নকাজের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মেয়র আ জ ম নাছির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে মোশাররফ ভাইয়ের (গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি পার্কটির উন্নয়ন করবেন বলে জানিয়েছেন।’ মেয়রও দাবি করেন, সুইমিংপুল পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়নি। সেখানে সাঁতার কাটা ঝুঁকিপূর্ণ।
এ বিষয়ে মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ওই পার্ক নান্দনিক করে তোলা হবে। সুইমিংপুল ও জিমনেসিয়ামের বদলে সেখানে ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) এবং ওয়াটার বডি (কৃত্রিম লেক) নির্মাণ করা হবে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পার্কটিকে নতুন করে সাজানোর জন্য ১২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে আছে।
গণপূর্ত বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মুনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মাসে প্রকল্পের অনুমোদন হলে জুলাইয়ের শেষের দিকে কাজ শুরু হবে। দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
সুইমিংপুল নির্মাণ করার পরও তা ফেলে রাখা এবং সেখানে আবার নতুন প্রকল্প নেওয়াকে সরকারি অর্থের অপচয় বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ সিকান্দার খান। তিনি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে অর্থ যেমন নষ্ট হয়, তেমনি নগরবাসীও কোনো সুফল পান না। এই দেশে যে যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তাঁর ভাবনা থাকে কীভাবে তাঁর সময়কে স্মরণীয় করে রাখা যায়। এটি করতে গিয়ে তাঁরা হুটহাট করে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব প্রকল্প মানুষের কোনো কাজে আসে না।
এদিকে চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামের খেলার মাঠটি প্রায় চার একরের। এর অর্ধেক জায়গা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়েছে সুইমিংপুল নির্মাণের কাজ। মাঠটি ছোট হয়ে যাওয়ায় কিশোর-তরুণদের খেলার জায়গা কমে গেছে। এই মাঠে একসময় জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, নুরুল আবেদিন নোবেলরা অনুশীলন করেছেন। এই মাঠে খেলেছেন আফতাব আহমেদ চৌধুরী ও তামিম ইকবালের মতো ক্রিকেটার।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী খেলার মাঠে সুইমিংপুল নির্মাণ বন্ধের দাবি তুলেছেন। আবার নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সেখানে সুইমিংপুল নির্মাণের পক্ষে। তিনি চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থারও সাধারণ সম্পাদক। গত ১৮ এপ্রিল সুইমিংপুলের নির্মাণকাজ বন্ধ করা নিয়ে মহিউদ্দিনের অনুসারী চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের কর্মসূচিকে ঘিরে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ২৫ জন আহত হন।
খেলার মাঠে সুইমিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করার বিষয়টির সঙ্গে দলীয় রাজনীতি যুক্ত হয়ে গেছে বলে জানান চট্টগ্রামের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ক্রিকেটার। এ নিয়ে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1194906/