২৭ মে ২০১৭, শনিবার, ১১:৩৮

এতিমের জমিখেকো ছাত্রলীগ নেতা

মা-বাবার একমাত্র সন্তান রাবেয়া বিল্লাল ফাল্গুনী। আর তাই বাবা আবুল কাশেম বিল্লাল এবং মা খোদেজা বেগম শিল্পীর মৃত্যুর পর যেন অকূল পাথারে পড়েন তিনি। রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁও পানির ট্যাংকির সামনে মা-বাবার রেখে যাওয়া একখণ্ড জমির ওপর চারটি দোকানের ভাড়া দিয়ে নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন এতিম এই মেয়ে।

কিন্তু মা-বাবার অবর্তমানে এক দিনেই ফল্গুনীকে পথে বসিয়েছেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা গাজী নাজমুল হাসান তালহা। আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) সূত্রে নিজেকে মালিক দাবি করে গত শনিবার দলবল নিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার ওই জমি দখল করে নিয়েছেন তিনি। তালহা শেরেবাংলানগর থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ২৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও।
ওই জমিতে থাকা দোকান মালিকরা জানান, ফাল্গুনীর জমিতে থাকা চারটি দোকানের মালপত্র ভেতরে রেখেই দোকান তালা মেরে দেন তালহা ও তাঁর ক্যাডাররা। দোকান মালিকরা অনেক আকুতি মিনতি করলে কোনো মালপত্র বের করার সুযোগ দেয়নি তারা। এক সপ্তাহ ধরে দোকান বন্ধ থাকায় মালিকরা পরিবারপরিজন নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
ঘটনার পর পরই শেরেবাংলানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ফাল্গুনী। তবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ফাল্গুনীর অভিযোগ, জমি উদ্ধারের জন্য শেরেবাংলানগর থানা পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না তিনি। এমনকি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ফোরকান হোসেনের কাছে গেলেও কোনো বিচার পাননি। বরং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে কাউন্সিলরের সামনেই তালহা অকথ্য ভাষায় তাঁকে গালাগাল করেন।
গত বৃহস্পতিবার দোকানের মালিক, ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৪০ বছর ধরে এই জমি ভোগদখল করে আসছিলেন আবুল কাশেম বিল্লাল ও তাঁর স্ত্রী খোদেজা বেগম শিল্পী। তাঁদের মৃত্যুর পরে জমিটি ভোগ করে আসছেন তাঁদের একমাত্র সন্তান রাবেয়া বিল্লাল ফাল্গুনী। প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের জমিটিতে চারটি দোকান আছে। জাফর মিয়ার ‘ডেইলি শপ জেনারেল স্টোর’, মাসুদ রানার ‘রানা বিজনেস সেন্টার’, বাদশা মিয়ার ‘আরিফ স্টেশনারি’ এবং সেলিমের ‘শাহীন ফার্মেসি’।
দোকান মালিকরা জানান, গত শনিবার বিকেলে শতাধিক ক্যাডার নিয়ে এসে দোকানগুলোতে তালা লাগিয়ে দোকানের সামনে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হাসান তালহা। ওই সাইনবোর্ডে লেখা ছিল—‘আমমোক্তারনামা সূত্রে এই জমির মালিক নাজমুল হাসান তালহা ও সোহেল রানা। ’
এ বিষয়ে ফাল্গুনী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মা-বাবার রেখে যাওয়া জমির ওপর চারটি দোকানের ভাড়া দিয়েই আমার সংসার চলত। কিন্তু হঠাৎ ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হাসান তালহা ও তাঁর লোকজন এসে দোকানে তালা মেরে দেন। নিজেকে মালিক দাবি করে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন। প্রতিকারের জন্য স্থানীয় কাউন্সিলর ফোরকান হোসেনের কাছে গেলে সেখানেই তালহা ও তাঁর লোকজন আমাকে নোংরা ভাষায় গালাগাল করে এবং বাড়াবাড়ি করলে এলাকাছাড়া করার হুমকি দেয়। ওই সময় কাউন্সিলর কিছুই বলেননি। ’
ফাল্গুনী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘কাউন্সিলরের ইন্ধন পেয়েই তালহা আমার জমিটুকু দখলে নিয়ে দোকানে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। ’
তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘জমি উদ্ধারের জন্য থানা পুলিশের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। কাউন্সিলরও কোনো সহায়তা করছেন না।
তা ছাড়া ছাত্রলীগ নেতা তালহার হুমকির পর চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ফাল্গুনী। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জমিটি ফেরত পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন।
এদিকে ছাত্রলীগ নেতার এই অপকর্মে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, তালহা হাইব্রিড নেতা। কয়েক বছর আগেও তার কোনো নাম শোনা যায়নি। কিন্তু এখন সে থানা এবং ওয়ার্ডের দুটি পদে থেকে অনিয়ম করে যাচ্ছে।
শাহীন ফার্মেসির মালিক মো. সেলিম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফাল্গুনীর বাবার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে আমি ২৩ বছর ধরে এখানে দোকান করছি। কিন্তু শনিবার হঠাৎ করে আমাদের দোকান তালা মেরে দেওয়া হয়। দোকানের ওষুধও বের করতে পারিনি। দুজন অল্প বয়সী ছেলে এসে মালিকানা দাবি করছে। আমরা ভাড়াটিয়ারা এখন কষ্টে আছি। ’
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ায়। আর সেই ছাত্রলীগের নেতা যদি এতিম মানুষের জমি দখল করে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইউনূস মোল্লা বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা তালহার কারণে আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। ওকে মদদ দিচ্ছে স্থানীয় একজন নেতা। ’
শেরেবাংলানগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মিন্টু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘ছাত্রলীগ নামধারী ছেলেটির কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এর আগে চোখে পড়েনি। হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসে যাওয়ার মতো ঘটনা সে ঘটিয়েছে। সে এতিম মেয়েটির জমি দখল করে দোকানে তালা মেরে দিয়েছে। আমি তাকে বলার পরও গুরুত্ব দিচ্ছে না। ’
তিনি বলেন, ‘শুনেছি ছাত্রলীগের পদ নিয়ে সে ইতিমধ্যে নানাজনের কাছ থেকে ধান্দাবাজি করে আসছে। তার কারণে ক্ষমতাসীন দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন নেতাদের জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ নাজমুল হাসান তালহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি দেড় মাস আগে জমিটি কিনেই মালিক হয়েছি। এ জন্য জমি দখল করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছি। ’ সাইনবোর্ডে আমমোক্তারনামার মালিকানার কথা লেখা আছে আর আপনি বলছেন ক্রয়সূত্রে মালিক, আসলে কোনটা ঠিক—এ প্রশ্নে তালহা বলেন, ‘আপনাকে কেন এসব উত্তর দেব। থানার পুলিশ আর কাউন্সিলরকে জানিয়ে সব কিছু করেছি। ’
পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ব্যাপারে তালহা দাবি করেন, শামসুল হক নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে ফাল্গুনী বলেন, এই জমির মালিক তাঁর বাবা। সে ক্ষেত্রে অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নেওয়ার কথা ভুয়া।
ওই জমি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. ফোরকান হোসেন বলেন, ‘ঘটনার পর মেয়েটি এসেছিল। তাঁকে কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেছি। দেখে দুই পক্ষকেই ডাকা হবে। ’ কাউন্সিলরের সামনে ফাল্গুনীকে গালাগাল করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। ’ আর তালহাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন ফোরকান হোসেন।
শেরেবাংলানগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহরাব আল হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের একটি অভিযোগ থানায় এসেছে। দুজন এসআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কাগজপত্র দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তাঁদের।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/05/27/501854