২৭ মে ২০১৭, শনিবার, ১১:৩৪

আদি বুড়িগঙ্গায় ‘দখল উৎসব’

বুড়িগঙ্গা দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটি শাখা চলে যায় দক্ষিণে কেরানীগঞ্জের দিকে, যা এখন মূল বুড়িগঙ্গা হিসেবে বইছে। কিন্তু আদি চ্যানেল হিসেবে পরিচিত উত্তরের শাখাটি আর বইতে পারছে না। দখলে দখলে এটি এখন সরু খাল। কোথাও প্রবাহ নেই। যেন নিশ্চিহ্ন হওয়ার অপেক্ষায় সবাই। দ্রুত চলছে ভরাটকাজ। প্লট বানিয়ে বিক্রি, বস্তি বানিয়ে ভাড়া প্রদান, ট্রাক-লেগুনা স্ট্যান্ড, গ্যারেজ, কারখানা, গোডাউন, ৯ শতাধিক দোকানের মোবাইল ফোন মার্কেটসহ গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা এই দখলে যুক্ত। কেউ কেউ বড় বড় কম্পানিকে দখলে সহায়তাও দিচ্ছে। এ নিয়ে সংঘর্ষও হচ্ছে। গত রবিবার ও গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে বুড়িগঙ্গার এমন চিত্র দেখা গেছে।

রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরের কোম্পানীঘাট ব্রিজে গেলে প্রথমেই নজর কাড়বে নদী দখলের দৃশ্য। বেড়িবাঁধ থেকে নেমে কামরাঙ্গীর চরে যেতেই ব্রিজটির ডান পাশে মাটি ফেলে আদি চ্যানেল ভরাটের কাজ চলছে। ব্রিজটির মাঝামাঝি স্থানে প্লাস্টিকের বস্তায় ইট-পাথরের সুরকি ভরে ভরাট চলছে। ১৫-২০ জন শ্রমিক বুড়িগঙ্গার জমিতে মাটি ফেলে ভরাট করছে। টিনের ব্যারিকেড দিয়ে নদী দখল চলছে। নদীর জমি কারা ভরাট করছে জানতে চাইলে মো. জয়নাল আবেদীন নামের কেয়ারটেকার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘যার ক্ষমতা আছে সেই ভরাট করছে। আমরা শুধু মালিকের নির্দেশে কাজ করছি। এর বেশি কিছু জানতে চাইলে কম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ’ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তাকর্মী মোখলেস মিয়া বলেন, ‘এখন তো আর নদী নাই, শুকাইয়া কাঠ হইয়া আছে। কম্পানি করলে অনেকের কাজের সুযোগ হইবো। খালি জায়গা ফালাইয়া রাখলে অন্যরা দখল করবো। ’ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ম্যাটাডোর কম্পানির লোকজন বুড়িগঙ্গার জমি ভরাট করছে। ওখানে নদীর আদি চ্যানেলের বেশির ভাগ জমিই তারা দখল করেছে। শুধু ম্যাটাডোরই নয়, পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট এলাকা থেকে সিকদার মেডিক্যাল পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার উভয় পাশের জমি দখল করে সরু খালে রূপান্তরিত করেছে দখলদাররা। নদীর কোনো জায়গায় পরিকল্পিতভাবে ভরাট করে পানি চলাচলের জায়গা রাখা হচ্ছে না। কামরাঙ্গীর চর রসুলপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, ‘বুড়িগঙ্গার নদীর এমন স্রোত ছিল যে নৌকা ছাড়া পার হওয়ার উপায় ছিল না। এক দশক আগেও এখানে পানি থইথই করত। এখন ভরাট করতে করতে খাল বানাইয়া ফালাইছে। ’ একই এলাকার মিয়াজ উদ্দিন ব্যাপারী বলেন, ‘দিনের পর দিন নদী দখল হচ্ছে, কেউ কিছুই বলছে না। কয়েক বছরের মধ্যে দেখা যাবে বুড়িগঙ্গার কোনো চিহ্ন থাকবে না এখানে। ’ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সরকারদলীয় স্থানীয় নেতারাই এসব দখল উৎসব চালাচ্ছেন। কিংবা টাকার বিনিময়ে দখল করতে সহযোগিতা করছেন।
গত মঙ্গলবার কোম্পানীঘাটে বুড়িগঙ্গার জমি দখল নিয়ে কামরাঙ্গীর চরের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন ও হাজারীবাগের ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরিকুল ইসলাম সজিবের সমর্থকদের মধ্যে হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় উভয় পক্ষের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছে।
কোম্পানীঘাট থেকে বেড়িবাঁধ ধরে দক্ষিণে যেতে দেখা যাবে নবাবগঞ্জ পার্কের ঠিক বিপরীত পাশেই নদী ভরাট করে গড়ে ওঠা অবৈধ মোবাইল ফোন মার্কেট। একটি-দুটি নয়, ৯ শতাধিক দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে প্রভাবশালীরা। ওই সব দোকান থেকে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন মার্কেটের দোকানদার আরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম ও মজিবুর রহমান জানান, সব কিছু বকেয়া রাখা যায়; কিন্তু ভাড়া বকেয়া রাখা যায় না।
সেখান থেকে একটু এগোলেই সেকশন ব্রিজের পাশেই ময়লা এবং মাটি দিয়ে ভরাট করে বানানো হয়েছে অটো-টেম্পো ও রিকশার গ্যারেজ। স্থানীয় কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের অফিস সহকারী নাদিম মিয়া ও তাঁর লোকজন জমি ভরাট করে অবৈধ স্ট্যান্ড নির্মাণ করেছে। সেই অবৈধ স্ট্যান্ডের কারণে প্রতিদিন প্রচণ্ড জ্যামে আটকে থাকতে হয় কামরাঙ্গীর চরবাসীকে। দুই বছর আগে এটি নির্মাণ করা হয়। প্রতিদিন এখানে ১০ হাজার টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করে।
বেড়িবাঁধ ধরে আরো একটু সামনে যেতেই বালুঘাটের পাশেই চোখে পড়ে নদীর মাঝখানে বিরাট টিনশেডের গোডাউন ও কারখানা। লাইট অ্যান্ড ইফেক্ট নামের প্রতিষ্ঠানটি অল্প কয়েক বছর হচ্ছে নদীর জমি দখল করে গোডাউন ও কারখানা নির্মাণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সুপারভাইজার মো. হাসান আলী বলেন, ‘নদীর জমি, নাকি ব্যক্তির জমি সেটা মালিক বলতে পারবেন। ’ আরো কিছু দূর যেতেই দেখা যায় সারি সারি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান বেড়িবাঁধের পাশে রাখা। নদীর জমি ভরাট করেই এসব ট্রাকস্ট্যান্ড নির্মাণ করা হয়েছে। একটি ট্রাকের হেলপার মো. রুবেল বলেন, ‘প্রতিদিন ১৫০ টাকা স্ট্যান্ডের লোকদের দিতে হয়। ’
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক যুগ আগ পর্যন্ত আদি চ্যানেলটি কামরাঙ্গীর চর, হাজারীবাগ, বসিলা হয়ে আমিন বাজারের কাছাকাছি এলাকায় আবারও বুড়িগঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এখন এ গতিপথটি একেবারেই বন্ধ। সেখানে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানাসহ অবৈধ স্থাপনা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, ১৫-২০ বছর আগেও এই আদি চ্যানেল দিয়ে বড় বড় নৌকা চলত। ছোটবেলায় এ নদীতেই তারা সাঁতরাত, মাছ ধরত।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/05/27/501867