২৬ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৩৪

ডিবি কার্যালয় থেকে ফেরা বিএনপি নেতা

গুম আতঙ্কে ১৬ ঘণ্টা কেটেছে নির্ঘুম রাত

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ডিবি কার্যালয়ে ১৬ ঘণ্টা ‘আটক’ থাকার সময় চরম ভয় ও গুম আতঙ্কে ছিলেন। স্ত্রী-কন্যা কিংবা দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে আবার ফিরে আসতে পারবেন এমন আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। বারবার তার মনে হচ্ছিল ইলিয়াস আলীসহ গুম হওয়া বিএনপি নেতাদের কথা। ডিবি কার্যালয়ে একটি চেয়ারে তার পুরো রাত নির্ঘুম কেটেছে। শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বৃহস্পতিবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাকে ডিবি তুলে নেয়ার পর মনে হয়েছিল স্ত্রী-কন্যার কাছে আর ফিরে যেতে পারব না। জীবনের ঝুঁকি থেকে ফিরে আসতে পেরেছি। এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।’ তিনি এর বেশি আর কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে দেখা করার কারণেই শেখ মহিউদ্দিনকে ডিবি তুলে নিয়ে যায় বলে তারা ধারণা করছেন। ডিবি কার্যালয়ে শেখ মহিউদ্দিনকেও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করেন- কেন মির্জা ফখরুলের সঙ্গে দেখা করেছেন? নাশকতার সঙ্গে জড়িত আছেন কিনা? গোয়েন্দাদের কেউ কেউ রাতভর শেখ মহিউদ্দিনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলেও অনেকে ভালো ব্যবহার করেছেন বলেও নেতারা জানান।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর আরামবাগ থেকে ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন লোক শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে এনে আরামবাগে একটি বাসে চট্টগ্রামের উদ্দেশে তুলে দেয়া হয়। বুধবার রাত ২টার দিকে এ বিএনপি নেতা বাসে চট্টগ্রামের অলঙ্কার মোড়ে পৌঁছলে তাকে দলীয় নেতাকর্মী ও পরিবারের লোকজন বাসায় নিয়ে যান। এক রাত নির্ঘুম ও মানসিক যন্ত্রণায় থাকা শেখ মহিউদ্দিন বৃহস্পতিবার বাসাতেই অবস্থান করেন। ছিলেন বিশ্রামে। বিকালে তিনি যুগান্তরকে তার আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

অন্যদিকে বুধবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির অভিযোগ ছিল পুলিশের কাছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার রাতে আরামবাগ বাস কাউন্টার থেকে তাকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। পরে অভিযোগকারী ও মহিউদ্দিনকে একসঙ্গে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘক্ষণ কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বুধবার দুপুর ৩টার দিকে মহিউদ্দিনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

কেন চট্টগ্রামের ‘ক্লিন ইমেজের’ এ বিএনপি নেতাকে সেদিন তুলে নেয়া হয়েছিল, কেনই বা দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য। একটি সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নাশকতার পরিকল্পনা করছে এমন তথ্য রয়েছে সরকারের গোয়েন্দাদের কাছে। তাছাড়া শেখ মহিউদ্দিনকে তুলে নেয়ার একদিন আগে তিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করতেই শেখ মহিউদ্দিন মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন কিনা এ বিষয়টি নিশ্চিত হতে ডিবি তাকে তুলে নিয়ে যায়। তবে বিএনপিরই অপর একটি সূত্র বলছে, আগামীতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি পদ পেতে আগ্রহী শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। এ কারণে দলের ভেতরেই তার শক্ত কোনো প্রতিপক্ষ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাকে ভুল বুঝিয়েছে।

সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থা ১৫ দিন আগেই শেখ মহিউদ্দিনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল। তিনি চট্টগ্রামে কী করছেন, কোন নেতার সঙ্গে দেখা করছেন, কোথায় যাচ্ছেন এসব বিষয় পর্যবেক্ষণে ছিল গোয়েন্দাদের। পাশাপাশি তার মোবাইল ফোনও ট্র্যাকিং করা হচ্ছিল। আটক হওয়ার আগের দিন সোমবার দুপুরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তার উত্তরার বাসায় দেখা করেছিলেন বিএনপি নেতা শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। গোয়েন্দারা শেখ মহিউদ্দিনকে তার ১৫ দিনের গতিবিধির বিষয়ে জানান। তাকে ডিবি কার্যালয়ে একজন যুগ্ম কমিশনার ও একজন সহকারী কমিশনার জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে যারা তাকে আরামবাগের রিল্যায়েন্স পরিবহনের বাস থেকে তুলে নিয়ে যান সেসব গোয়েন্দা কর্মকর্তারা শেখ মহিউদ্দিন কে তা জানতেন না বলেও জানান। তারা উপরের নির্দেশেই শেখ মহিউদ্দিনকে শুধু আটক করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন।

দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক জিয়াউদ্দিন চৌধুরী আশফাক যুগান্তরকে বলেন, ‘শেখ মহিউদ্দিন তার বাবার কিডনির চিকিৎসার বিষয়ে ঢাকায় যান কয়েকদিন আগে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম ফিরে আসার জন্য রিল্যায়েন্স পরিবহনের একটি কোচে ওঠেন। এ সময় তার সঙ্গে এনাম নামে এক ব্যবসায়ী বন্ধু ছিলেন। যার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত। আরামবাগে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো ছিল কোচটি। ওই কোচে উঠে সিটে বসেন মহিউদ্দিন ভাই ও এনাম। এ সময় ওয়াকিটকি হাতে কয়েকজন কোচে উঠে নিজেদের ডিবির সদস্য বলে পরিচয় দেন। তারা শেখ মহিউদ্দিনকে তাদের (ডিবির) সঙ্গে যেতে হবে বলে জানান। কেন প্রশ্ন করা হলে কোনো উত্তর না দিয়ে কথিত ডিবি সদস্যরা মহিউদ্দিনের হাতে থাকা দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে নেন এবং অফ করে দেন। এ সময় মহিউদ্দিনের সঙ্গে থাকা তার বন্ধু এনামও মহিউদ্দিনের সঙ্গে যেতে চাইলে তখন ডিবি পরিচয়দানকারীরা বলেন, তাহলে তিনিও (এনাম) আর আসতে পারবেন না।’ এ সময় মহিউদ্দিন তার বন্ধু এনামকে চলে যেতে বলেন।

এ সময় ডিবি পরিচয়দানকারীরা শেখ মহিউদ্দিনকে নিয়ে রাস্তার অপর পাশে দাঁড়ানো একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। আশফাক জানান, এনামই শেখ মহিউদ্দিনকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়ার বিষয়টি পরিবারকে জানান। এরপর থেকেই শেখ মহিউদ্দিনকে ফিরে পাওয়া নিয়ে তার পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। তাদের আশঙ্কা ছিল মহিউদ্দিনকে গুম করা হবে। এ আশঙ্কা থেকে দক্ষিণ জেলা বিএনপি বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে শেখ মহিউদ্দিনকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হয় আদালতে হাজির নয় তো পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার দাবি জানায়। সংগঠনের জেলা সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরীও শেখ মহিউদ্দিনকে গুম করা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সংবাদ সম্মেলন করার দেড় ঘণ্টার মধ্যে বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে এই বিএনপি নেতাকে গোয়েন্দা পুলিশ আরামবাগে নিয়ে এসে চট্টগ্রামমুখী বাসে তুলে দেয়।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/26/127471