২৬ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১১:২৫

জনগণ চাপে পড়বে নতুন ভ্যাট আইনে

নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন প্রযুক্তি ও রেয়াতনির্ভর। এ আইনে হিসাব সংরক্ষণসহ ভ্যাটের যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনের মাধ্যমেই পরিচালিত হবে। অথচ বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এখনও অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করে না। একই সঙ্গে নতুন এ আইনে অনেক ক্ষেত্রে উপকরণে কর রেয়াত নেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে আইনটি কার্যকর হলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে। সামগ্রিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে।

এ ছাড়া আইনটি কার্যকর হলে বিদ্যুৎ ও শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। এমন চিত্র উঠে এসেছে খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়, আইনটি কার্যকর হলে শুধু জনগণই চাপে পড়বে তা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশীয় শিল্পও।

সরকার আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানে ১৯৯১ সালের আইনে 'একাধিক হ্রাসকৃত হারে' ভ্যাট আদায় করা হয়। নতুন আইনে সব ক্ষেত্রে একই হারে (১৫ শতাংশ) ভ্যাট আদায় করা হবে। ব্যবসায়ীরা তা কমিয়ে ১০ শতাংশের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে

অন্যান্য দেশের মতো ভ্যাটের হারে বহুস্তর রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সরকার কিছুটা কমিয়ে একই হারে ভ্যাট আদায় করতে চায়।

এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভ্যাট একটি পরোক্ষ কর। ব্যবসায়ীরা এটি ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করে সরকারকে প্রদান করেন। ফলে ভোক্তার খরচ বাড়বে। বর্তমানে ১৬০ দেশে ভ্যাট আরোপ রয়েছে। নিউজিল্যান্ড, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা_ এ পাঁচ দেশ ছাড়া বাকি দেশগুলোতে একাধিক হারে ভ্যাট রয়েছে।

জানা গেছে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব কীরূপ হতে পারে তা মূল্যায়নে এনবিআরের একজন সদস্যের নেতৃত্বে আটজনের কমিটি করা হয়। এ কমিটি অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা যাচাই করে ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করে সম্প্রতি এনবিআরে জমা দেয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এনবিআর এমন এক সময় মূল্যায়নটি করেছে, যখন আইনটি বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে সরকার। ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের প্রণয়ন প্রক্রিয়া এ দেশের অর্থনীতির বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অবশ্য এনবিআরের (ভ্যাট নীতি) সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নতুন ভ্যাট আইন ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব। এতে পণ্য ও সেবার প্রতি স্তরে রেয়াত বা ক্রেডিট নেওয়ার সুযোগ থাকায় সামগ্রিকভাবে করের চাপ কমবে। ফলে পণ্যমূল্য বাড়বে না। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, নতুন আইন কার্যকর হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। চাপ বাড়বে ভোক্তার ওপর। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ বলেন, নতুন আইনে উপকরণে কর রেয়াতের সুযোগ নেই। এতে করে পণ্যমূল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কষ্ট বাড়বে সাধারণ মানুষের।

নতুন আইন কার্যকর হলে বাজারে তিনভাবে প্রভাব পড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। বিদ্যমান আইনে স্থানীয় অনেক পণ্যে বিশেষ ছাড় দিয়ে নির্ধারিত ট্যারিফের ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করা হয়। এ ব্যবস্থায় কর আদায় করায় পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হয়। এমন পণ্যের মধ্যে গুঁড়ো দুধ, বিভিন্ন মসলা, বিস্কুট, এলপি গ্যাস, কাগজ, ইট, বৈদ্যুতিক খুঁটি, রড, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্বসহ আরও কিছু পণ্য রয়েছে। নতুন আইনে এগুলোর উপকরণে কর রেয়াত নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে উল্লেখ করা হয়, নতুন আইনে নির্ধারিত ট্যারিফ মূল্য উঠে যাওয়ায় এসব পণ্যের দাম বাড়বে।

বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে প্রতি টন রডে ভ্যাট আদায় করা হয় ৯০০ টাকা। নতুন আইন কার্যকর হলে প্রতি টনে ভ্যাট দিতে হবে সাত হাজার টাকার বেশি। এতে রডের দাম বেড়ে যাবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রড উৎপাদনের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ, ভাঙাড়ি, লোহার সামগ্রী ইত্যাদি ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ফলে এসব উপকরণের কর রেয়াত নেওয়া সম্ভব নয়। কর রেয়াত সুবিধা না নিতে পারলে দাম বাড়িয়ে দেবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া রডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নাট-বোল্ট, তারকাঁটা, স্টূ্ক্র ইত্যাদির দামও বাড়বে। শুধু রডের ক্ষেত্রে নয়, উপকরণের রেয়াত নেওয়ার সুযোগ না থাকায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বর্তমান আইনে সেবার ১৫ খাতে বিশেষ ছাড় দিয়ে সংকুচিত ভিত্তিমূল্য অনুযায়ী ভ্যাট আদায় করা হয়। এতে ওই সব খাতে সস্তায় সেবা পায় জনগণ। নতুন আইনে এ প্রথা থাকছে না। ফলে আইনটি কার্যকর হলে সেবা খাতের খরচও আগের চেয়ে বাড়বে। এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করতে বর্তমানে বিদ্যুৎ-গ্যাসে বিশেষ ছাড় দিয়ে ভ্যাট আদায় করা হয়। নতুন আইনে বিদ্যুৎ-গ্যাসে ভ্যাট আরও বাড়বে বলে দামও বাড়বে। এতে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। নতুন আইনে বিদ্যুৎ উপকরণে কর রেয়াত নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তা ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া বাস্তবসম্মত নয়। এতে জটিলতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কলমে ভ্যাট নেই। নতুন আইনে ভ্যাট দিতে হবে বলে দাম বাড়বে। একইভাবে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাগজে বিশেষ ছাড় দিয়ে টনপ্রতি নির্ধারিত ট্যারিফের ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করা হয়। নতুন আইনে কাগজের প্রকৃত দামের ওপর ভ্যাট আদায় করা হবে। এতে বেশি দামে কাগজ কিনতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নতুন আইন কার্যকর হলে বিভিন্ন ওষুধের দামে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ওষুধের বিপণন প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হবে। কারণ, বড় ওষুধ বিক্রেতাকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। অন্যদিকে, ছোট ব্যবসায়ীদের ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এতে ওষুধের দাম নির্ধারণ নিয়ে বিশাল ফারাক তৈরি হবে। ফলে ওষুধের বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। একই পরিস্থিতি দেখা দেবে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। নতুন আইনে নামিদামি বড় রেস্তোরাঁ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হবে। অন্যদিকে ছোট রেস্তোরাঁকে দিতে হবে ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট। এ অসম প্রতিযোগিতার বিরূপ প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে।

দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে :বর্তমানে দেশীয় চা শিল্পের সুরক্ষায় আমদানি করা চায়ে ২০ ভাগ সম্পূরক শুল্ক আরোপ আছে। নতুন আইনে এ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার হলে বিদেশ থেকে আনা চা সস্তা হবে। এতে দেশীয় চাশিল্প মার খাবে। চায়ের মতো নতুন আইনে আমদানি পর্যায়ে বেশিরভাগ পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক তুলে নেওয়া হবে ও অনেক পণ্যে তা কমানো হবে। ফলে বিদেশ থেকে আনা এসব পণ্য আগের চেয়ে সস্তা হবে। এর বিপরীতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের খরচ বেড়ে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে দেশীয় শিল্প বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

http://bangla.samakal.net/2017/05/26/295757