২৬ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৫৬

সন্তান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে দিন দিন

অবক্ষয়ের ভয়াল রূপ-৫

দেশে স্কুলপড়–য়া শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলে একে অপরকে পশ্চিমা কায়দায় প্রেম নিবেদন করছে। রাজধানীর নামকরা দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু দিন আগে ঘটে গেছে এ ঘটনা। হোটেল আর নিষিদ্ধ পল্লীতে মিলছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীর লাশ। শুধু তাই নয় বিয়ে ছাড়াই একসাথে বসবাস করতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছে মেডিক্যাল পড়–য়া একছাত্রী। একইভাবে খুন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আরেক শিক্ষার্থী। অপরাধী গ্রুপের সাথে জড়িয়ে খুন হচ্ছে স্কুলপড়–য়া কিশোর। মাদক আর পর্নোগ্রাফি? সে তো ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী আকারে।

দ্রুতগতিতে চলছে সামাজিক অবক্ষয়। নিত্যনতুন মাত্রায় সমাজের মানুষকে গ্রাস করছে নানা ধরনের অধঃপতন। আর সন্তান নিয়ে বহুমাত্রিক উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন পার করছে অভিভাবক। সামাজিক অবক্ষয়ের যেসব খবর প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে তাতে কোথায় গেলে প্রাণপ্রিয় সন্তানকে নিরাপদে মানুষ করা যাবে সে চিন্তায় দিশেহারা অনেক অভিভাবক। কিন্তু কোথাও যেন নেই আস্থার স্থল। অনৈতিকতার চর্চা, নৈরাজ্য আর পশুত্ব ছেয়ে গেছে সর্বত্র। সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে হয়রানি আর বিড়ম্বনার শেষ নেই অভিভাবকদের। মানুষ গড়ার স্থান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েও সন্তান নিয়ে এখন আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না মা-বাবা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট অভিভাবকেরা। স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট, ঘন ঘন পরীক্ষা, প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা বিড়ম্বনার পাশাপাশি অভিভাবকদের গ্রাস করছে সামাজিক অবক্ষয়ের দুর্ভাবনা।

সন্তান নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগের অন্যতম বিষয় মাদক। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদকের সর্বগ্রাসী ছোবল। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে প্রায়ই উদ্ধার করা হচ্ছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক। মাদকের এসব খবরে সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে পাঠিয়ে কোনো মা-বাবাই আর নিশ্চিন্তে দিন পার করতে পারছেন না। অথচ কয়েক বছর আগেও মা-বাবার এ ধরনের দুশ্চিন্তা ছিল না। অপর দিকে মাদকের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরো নানা ধরনের অপরাধ। মাদক এবং যৌনতা অনেক ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। পর্নোগ্রাফি, মাদক, প্রেম পরকীয়া, ধর্ষণ আর এসব কারণে সঙ্ঘাত, হানাহানি, গুম খুনের ঘটনা ঘটছে। সন্তান নিখোঁজ, গুম, খুন, অজ্ঞাত পরিচয় লাশ উদ্ধার প্রভৃতি খবরের পেছনে অনেক সময় থাকে মাদকের ছোবল। নানাবিধ জটিল সমস্যায় জড়িয়ে তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীরাও এমনসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে যাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় গোটা জাতি। তাই কখন কোনো সহপাঠীর মাধ্যমে তার সন্তানের হাতেও চলে আসে মাদক এ দুর্ভাবনায় অস্থির অভিভাবকেরা।

মাদক শুধু শহরের ঐশীদের ধ্বংস করছে না বরং এই আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলা এমনকি পাড়াগাঁয়েও। গ্রামের ছোট ছোট হাটবাজার, রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান এলাকায়ও পড়েছে মাদকের থাবা। ফলে উপজেলা এবং গ্রামের স্কুল কলেজপড়–য়া সন্তানেরাও জড়িয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। দেশের কোনো কোনো এলাকায় মাদক এমনভাবে ছেয়ে গেছে যে, সন্তানকে এ থেকে বাঁচাতে অনেকে পুরো পরিবার নিয়ে অন্য এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ সন্তানকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তারপরও সন্তান নিয়ে ভাবনামুক্ত হতে পারছেন না তারা। কোনো কোনো এলাকায় মাদক এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, সেসব এলাকা বিভিন্ন মাদকের নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে টেকনাফ বিষয়ে এ ধরনের খবর বেরিয়েছে স্থানীয় পত্রিকায়। ইয়াবার ব্যবসায় করে টেকনাফে অগণিত বিত্তহীন রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। মাদকের টাকায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন এলাকায় সারি সারি বিলাসবহুল বাড়ি যাদের কিছু দিন আগেও ভিটাবাড়ি পর্যন্ত ছিল না ঠিকমতো।

ফারুক নামে একজন অভিভাবক ফোনে জানিয়েছেন একটি বিশেষ নম্বর থেকে তার কাছে কল আসে প্রায়ই। বলা হয় তারা মডেল অভিনেত্রীসহ বিভিন্ন বরেণ্য লোকদের সাথে কথা বলিয়ে দেবে। আসলে তারা খারাপ মেয়েদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কাজ করছে এবং কেউ তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব মেয়ে প্রেমের অভিনয় করে আর অশ্লীল কথাবার্তা বলে।

ফারুকের মতো এ ধরনের অভিযোগ অগণিত। প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার, সামাজিক যোগাযোগ, বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড দোস্ত কালচারের বিস্তৃতি, পর্নোআগ্রাসন, নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশার ফলে তরুণসমাজ জড়িয়ে পড়ছে বহুগামিতা, ধর্ষণ, পরকীয়ার মতো নানা নষ্টামির সাথে। কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে ত্রিমুখী, চতুর্মুখী সম্পর্কে। এ নিয়ে বন্ধুবান্ধবের মধ্যেও অনেক সময় ঘটছে হানাহানি। এসবের রেশ ধরে ঘটছে। আত্মহত্যাসহ চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা। বিভিন্ন এলাকায় কিশোর তরুণরা গড়ে তুলছে নানা ধরনের অপরাধী গ্রুপ। কখন কার সন্তান তাদের শিকারে পরিণত হয় তা নিয়ে আতঙ্কিত সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরা।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফির বিস্তারে নৈতিকতার বাঁধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ছড়িয়ে পড়ছে লজ্জাহীনতার সংস্কৃতি। নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা থেকে হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ। সর্বশেষ রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থীকে বারবার ভোগের টার্গেট নিয়েছিল ধর্ষকেরা। এ ছাড়া সিলেটে এক তরুণ জনৈক মহিলাকে ধর্ষণ করে তা ভিডিও করে। এরপর ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ওই মহিলাকে ছাড়াও তার মেয়েকেও বারবার ধর্ষণ করে। এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে অহরহ দেশের নানা প্রান্তে। এসব কারণে সন্তানের জন্য এখন মা-বাবার বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন।

মোবাইল কোম্পানির নানাবিধ অফারের সুযোগ নিয়ে তরুণ-তরুণীরা একসময় রাতের পর রাত পার করেছে কথা বলে। মোবাইল এখন পরিণত হয়েছে মিনি কম্পিউটারে। আর মোবাইলের সাথে ইন্টারনেট সংযোগের কারণে হয়েছে অপরাধের পোয়াবারো। টিভি, রেডিও, ক্যামেরা থেকে শুরু করে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টুইট, ইনস্টাগ্রামসহ ইন্টারনেট দুনিয়ার যত শাখা-প্রশাখা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে তার প্রায় সবই চলে এসেছে মোবাইলে। সরাসরি ভিডিও কল করা থেকে ভিডিও জগতের সব ভাণ্ডার এখন উন্মুক্ত। আর শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমন কি বয়স্করা পর্যন্ত অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন ইন্টারনেট দুনিয়ার নিষিদ্ধ গলিতে। এ থেকে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে নানামাত্রিক অপরাধ ও বিকৃতি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/223133