২৪ মে ২০১৭, বুধবার, ৮:১৫

দুই স্তরের ভ্যাট কাঠামো

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরই চূড়ান্ত হবে ভ্যাটহার * ১২৭ পণ্য ও সেবায় অব্যাহতি সম্প্রসারণ * আড়াই কেজি পণ্য কিনলেই ভ্যাট ফ্রি * টার্নওভার ৮০ লাখের স্থলে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা

নতুন ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক কাটছে না। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যেও ভ্যাটহার নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। রোববারও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যাটের হার একটিই হবে। তবে এ হার কমবে। মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রীও বলেছেন, ভ্যাটহার ১৫ শতাংশের নিচে থাকছে। কিন্তু দায়িত্বশীল সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এনবিআর আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে একক ভ্যাটহার থাকছে না। সর্বোচ্চ ভ্যাটহার ১৫ শতাংশই রেখে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে হ্রাসকৃত হার কার্যকর করার সম্ভাবনা বেশি। এভাবে দুই স্তরের ভ্যাট কাঠামো ঠিক করে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে এনবিআর। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরই ভ্যাটহার চূড়ান্ত হবে জানিয়ে এনবিআরের একজন সদস্য জানান, আমরা বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছি। তবে দুই স্তরে ভ্যাট কার্যকরের প্রস্তুতি রয়েছে। হার কমিয়ে তা একক রাখা হলে রাজস্ব আদায় ব্যাহত হবে।


ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্বাচনের আগে জনঅসন্তোষ এড়াতে নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন কার্যকর হলে নিত্যপণ্য মূল্যসহ কোন খাতে কি প্রভাব পড়বে, মূল্যস্ফীতিসহ দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা বা এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কিনা তা যাছাইয়ে এনবিআর মাঠ পর্যায়ে কোনো জরিপের উদ্যোগ নেয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র স্বীকার করেছে, নতুন আইনে সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে এনবিআর কোনো জরিপ বা গবেষণা করেনি। এটা না করে কার্যকর হলে তা জনরোষ সৃষ্টি করবে। আর এ সুযোগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মাঠ গরম করার ইস্যু পাবে। এ জন্য পণ্য মূল্য এবং স্থানীয় শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়বে এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ আছে।

সংশিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৯১ সাল থেকে সর্বস্তরে সহনীয় হওয়ায় সর্বোচ্চ ভ্যাটহার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এনবিআরের প্রস্তাব ছিল একক ভ্যাট হার ১৫ শতাংশের স্থলে ১৩ শতাংশ করা। এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে এ বিষয়ে দ্বিমত থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে ২৫ বা ২৬ মে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকটি হতে পারে। অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ বৈঠকেই বিতর্কিত ভ্যাট হার, ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা, কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো, সিগারেট ও বিড়ি শিল্পের মূল্যস্তর ও সম্পূরক শুল্ক হার, আবাসনখাতে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ সম্প্রসারিত করাসহ বেশকিছু জটিল বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে। এ বৈঠকের জন্য এনবিআর ভ্যাটহার নিয়ে নতুন একটি প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রে এ সম্পর্কিত কিছু তথ্য যুগান্তরের হাতে এসেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৫ শতাংশের একক ভ্যাট হারই কার্যকর থাকছে। তবে উৎপাদন ও সেবা খাতে যেসব ব্যবসায়ী রেয়াত নেয়ার সামর্থ্য রাখেন না তাদের জন্য থাকছে বিশেষ হ্রাসকৃত হার। এতে ক্ষুব্ধ ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। এ ছাড়া সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলোকে ভ্যাট অব্যাহতির বিদ্যমান সীমা ৩০ লাখ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৬ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ জন্য আইনের ধারা ২-এর দফা (৪৮) সংশোধন করা হচ্ছে। একইভাবে টার্নওভারের বিদ্যমান সীমা প্রায় ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের খুশি করতে টার্নওভার ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। এ জন্য নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ধারা ২-এর দফা (৫৭) সংশোধন করার প্রস্তাব করা হবে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রস্তাবিত বাজেটে ১২৭টি পণ্য ও সেবাখাতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে। নতুন ভ্যাট আইনে এ ধরনের অব্যাহতির কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে নিত্যপণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেশ কিছু খাতের জন্য বিদ্যমান আইনে থাকা সংকুচিত ভিত্তিমূল্যের আদলে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট থাকার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এনবিআরের প্রস্তাব অনুযায়ী আড়াই কেজি পর্যন্ত প্যাকেটজাত বিভিন্ন নিত্যপণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে। অর্থাৎ একসঙ্গে আড়াই কেজির বেশি এসব পণ্য না কিনলে ভ্যাট দিতে হবে না। এ তালিকায় আছে মাংস, সব ধরনের সবজি, ফল, তরল দুধ, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, গম, আটা ইত্যাদি। এ ছাড়া আদা, জিরা, লবঙ্গ, ধনিয়া, দারুচিনি, এলাচসহ অন্যান্য মসলায় আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়েও ভ্যাট থাকছে না। পাশাপাশি পাটজাত পণ্য এবং কৃষি খাতে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের বীজ, সেচ ও কীটনাশক, ফুল ও ফুলের তোড়াসহ কিছু পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি থাকছে। ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত সরকারের ১০ প্রকল্প, হাইটেক পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং সরকারি- বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে।

সূত্রমতে, সিগারেট, মোবাইল ফোন, তেল ও গ্যাস, গাড়ি, সিমেন্ট, ব্যাংকসহ বড় কয়েকটি খাতে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর রাখা হচ্ছে। এনবিআর হিসাব করে দেখিয়েছে মোট ভ্যাটের প্রায় ৮১ শতাংশই আসে এসব খাত থেকে। তারা বিদ্যমান ভ্যাটহার নিয়ে কোনো আপত্তিও করেনি। এসব খাতে এই হার সহনীয় হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্ধ কয়েকটি খাতের ব্যবসায়ীদের দাবিতে ভ্যাটহার কমানোর মতো ঝুঁকি নিলে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে- যা সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের লক্ষ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নতুন ভ্যাট আইনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভ্যাটের একক হার। অথচ কিছু খাতে ১৫ শতাংশ আর কিছু খাতে ১২ শতাংশ করা হলে কার্যত বহুস্তর ভ্যাটই থাকছে। তাতে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ অনলাইনের সফটওয়্যার একক হারের জন্য তৈরি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে গত এবং চলতি অর্থবছরে অনেক পণ্য ও খাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ আছে। এনবিআরের প্রস্তাবে আগামী অর্থবছরে ভ্যাটের এ হার বহাল থাকছে। এর বাইরে সীমিত কিছু পণ্যে নতুনভাবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু খাত ও পণ্যকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হচ্ছে। এর অধিকাংশই সেবা খাতে। এতে ভোক্তা পর্যায়ে দর বাড়ার যে আশঙ্কা ছিল তা দূর হবে। এ ছাড়া কিছু পণ্য ও খাত থেকে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে যেসব খাতে সংকুচিত ভিত্তিমূল্য কার্যকর আছে সে সব খাতে নির্দিষ্ট ভ্যাটহার নির্ধারণ করে দেয়া হবে।

এদিকে এনবিআরের বিভিন্ন কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমে দাবি করছেন, নতুন ভ্যাট আইনে সর্বত্র ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর হলেও তার দায় ভোক্তাদের ওপর পড়বে না। রেয়াতের মাধ্যমে সমন্বয় করা হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনবিআর এখনও বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত আড়াই বছর অনড় অবস্থানে থেকে এনবিআরের নীতিনির্ধারকরা অহেতুক জটিলতা ও বিতর্কের সুযোগ তৈরি করেছেন। আইএমএফের ফরমুলায় দেশের স্বার্থবিরোধী একটি আত্মঘাতী আইন জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ভ্যাট ইনক্লুসিভ হওয়ার কারণে ভ্যাটের আপাতন কমে ১৩ শতাংশ হবে। এনবিআরের এমন বক্তব্য ডাহা মিথ্যা। নতুন আইনে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য হলেও বিদ্যুতের দাম বাড়বে না। এটিও ঠিক নয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিলের ওপর গ্রাহকের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। এটা ১৫ শতাংশ হলে অবশ্যই বিদ্যুতের দাম কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাড়বে। এছাড়া নির্মাণ খাতে বর্তমানে ৬ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি ১৫ শতাংশ হলে পদ্মা সেতুসহ সরকারের সবগুলো বড় প্রকল্প খাতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বাড়বে। এছাড়া ইটের ওপর বর্তমানে প্রতি হাজারে ২২০০ টাকা ধরে এক সিজনে মাত্র তিন লাখ টাকা ভাটাপ্রতি আদায় করা হয়। নতুন আইন কার্যকর হলে ভাটাপ্রতি কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা আদায়যোগ্য হবে- যা নির্মাণ কাজের ব্যয় বহুগুণে বাড়াবে। এছাড়া বর্তমানে প্রতি টন রডে ভ্যাটের পরিমাণ মাত্র ৫০০ টাকা, নতুন আইন কার্যকর হলে এর পরিমাণ বেড়ে হবে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এর ফলে বিকাশমান রিয়াল এস্টেট সেক্টর এক প্রকার বসে যাবে। সুপার শপের কেনাকাটায় ৪ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য করায় এখানে কেনাকাটা করলেই বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে ক্রেতাকে। এতে মানুষ খোলাবাজার থেকেই পণ্য কিনতে আগ্রহী হবে। সুপারশপের মতো অত্যাধুনিক একটি উদীয়মান শিল্প এতে মুখ থুবড়ে পড়বে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/05/24/126954/