২৪ মে ২০১৭, বুধবার, ৭:৫৩

ব্যাংকগুলো লুটপাট সমিতিতে পরিণত

|| ড. মোঃ নূরুল আমিন || দেশের তফসিলী ব্যাংকসমূহের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ১৬ হাজার কোটি টাকা থেকে পুনঃ তফসিলীকরণের পরও এক বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৫শ’ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। বলাবাহুল্য, পুনঃ তফসিলীকরণ ছাড়াও ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপনের অনুমোদন দিয়েছে। অর্থাৎ পুনঃতফসিলীকরণ ও অবলোপনের অর্থ যোগ করলে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। দেশের অর্থ খাতের জন্য এই তথ্য অত্যন্ত ভয়াবহ। ঋণ খেলাপকারীদের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় না করে তা অবলোপন বা মাফ করে দেয়ার বিষয়টি অনেকের কাছেই প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দিচ্ছে। আবার পুনঃতফসিলীকরণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ জমা না নিয়েই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের পুনঃতফসীলের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে যারা ভাল ঋণগ্রহিতা ও ঋণ খেলাপ করেন না তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছে এবং খেলাপী কালচার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন না। প্রচলিত নীতি অনুযায়ী ঋণের টাকা মঞ্জুর এবং বিতরণের আগে ব্যাংকসমূহকে ঋণ গ্রহিতার চরিত্র, সামর্থ্য, সুপ্ত সম্ভাবনা (Character, Capacity, Capability) এবং ঋণের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতা, ফেরৎযোগ্যতা এবং আদায় যোগ্যতা (Reliability, Repayability and Realizability) প্রভৃতি নির্ণয় ও পরীক্ষা করে দেখতে হয়। এগুলো হচ্ছে ব্যাংক খাতের সাবধানতা ও দূরদর্শিতার অংশ। এই সাবধানতা না থাকলে বিনিয়োগ ফলপ্রসূ হয় না এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরতও আসে না। গত নয় বছর ধরে আমাদের দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো Banking Prudence এর এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো দেখেশুনে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারছেন না। সরকারি ব্যাংকগুলোতে অর্থনৈতিক (Feasibility) সম্ভাব্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিনিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারের বা সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি ও নেতৃবৃন্দের হুকুম তামিল করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা নিজেরাই ভাগাভাগি করে ঋণ নিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে যে, যে খাতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হচ্ছে। ঋণের ব্যবহারের সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকছে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ঋণ খেলাপকারী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং রাজনৈতিক নেতারাই ঠিক করছেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পদে কারা আসবেন। এরা এতই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যে ব্যাংকের সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দটিও করতে পারেন না। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয় অনিয়ম, অনাচার ও দুর্নীতির সাথে এত বেশি জড়িত যে, এ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কারো বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে ভয় পান না জানি তাদের গোপন বিষয়াবলী ফাঁস হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে, ব্যাংক খাতে ঋণ বেড়ে ৬ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে খেলাপীর পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। আবার, খেলাপী ঋণের ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা সোনালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের। ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপী ঋণ হচ্ছে ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। বিদেশী নয়টি ব্যাংকের খেলাপী ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ হচ্ছে ৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের দু’জন সিনিয়র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি দৈনিক রিপোর্ট করেছে যে, প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকেই একটি অশুভ সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারা ঠিক করেন কারা এমডি হবেন, কারা ঋণ পাবেন এবং কিভাবে ব্যাংক পরিচালিত হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের ফলে এই সিন্ডিকেটের উৎপাত আরো বদ্ধি পাবে এবং খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ ও ব্যাংকিং খাতের ডাকাতদের নিয়ে গড়ে ওঠা এ সিন্ডিকেট ভাল ব্যাংকগুলোকেও আর ভাল থাকতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বৃহত্তম ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান সততা ও নিষ্ঠার অনন্য রোল মডেল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় জবরদস্তি পরিবর্তন আনা এবং তার পেছনে সরকারের ইন্ধন এটাই প্রমাণ করে যে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ঋণ খেলাপের ঘটনা ঘটছে সরকারের প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায়ই তা হচ্ছে। তাদের আনুকূল্যেই এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের টাকা চুরি হয়েছে। তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আজ পর্যন্ত কোন শাস্তি হয়নি। রক্ষকরা এখন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন বলে মনে হয়। সরকার এতই দুর্নীতিপরায়ণ এবং অযোগ্য হয়ে পড়েছেন যে তাদের হাতে কোন কিছুই নিরাপদ থাকছে না। সারা দেশ একটি লুটপাট সমিতিতে পরিণত হয়েছে। যে যেখান দিয়ে পারছে লুটপাট করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে, এই প্রতিষ্ঠানটি এই খাতে বিদ্যমান পরিবেশে কোন অনুকূল পরিবর্তন সাধন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাদের মূলধন খেয়ে ফেলেছে এবং এ বাবদ সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি চেয়েছে। কারণ, ঘাটতিতে থাকা এসব ব্যাংক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। অসৎ ও অযোগ্য সরকারের হাতে পড়লে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের কি পরিণতি হয় তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বেসিক ব্যাংক। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটি খুবই ভাল ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ওই বছর ব্যাংকটির নীট মুনাফা ছিল ৬৫ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়। ২০১৩ সালে প্রথম বারের মতো ব্যাংকটি লোকসানে পড়ে। ওই বছর তার নীট লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ১১০ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৩০০ কোটি টাকা এবং এভাবে ২০১৬ সালে তার পরিমাণ শতকরা প্রায় তিনশ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ব্যাংকটি নজিরবিহীন লুটপাটের শিকার হয়। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০০৯-২০১৪ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এরপরই ব্যাংকটি ২ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে গত তিন বছরে সরকার ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন যোগান দিয়েছে। কিন্তু তারা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি এবং বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে তারা সরকারের কাছে আরো ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার লোন চেয়েছে। দুর্নীতিপরায়ন সরকারের হাতে পড়ে ইসলামী ব্যাংকের মতো একটি প্রেস্টিজ ব্যাংকের অবস্থা কখন বেসিক ব্যাংকের মতো হয় পর্যবেক্ষক মহল উদ্বেগের সাথে তা দেখার অপেক্ষা করছেন।
ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থা নিয়ে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিক একটি চমৎকার সম্পাদকীয় মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যটি স্বব্যাখ্যাত। এখন পাঠকদের সুবিধার্থে আমি নিচে তা হুবহু তুলে ধরছি।
“খেলাপী ও অবলোপন করা ঋণ আদায় কম হয়েছে এরকম ২০ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সভায় যে তথ্যটি বেরিয়ে এসেছে তা আসলে দিনে দিনে জমা হওয়া পাপের বোঝার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই সভায় বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, “বড় কয়েকজন গ্রাহক ঋণ নিয়ে পাচার করে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম সুবিধায় বাড়ি করেছেন। এসব জানার পরও আমরা কিছুই করতে পারছি না।”
এ কিছুই করতে না পারার দায় কার? প্রথমত, ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান যারা ঋণ আদায় করতে পারছে না। দ্বিতীয়ত অর্থ পাচার রোধে নিয়োজিত সংস্থা তথা সরকার। অর্থ পাচার রোধে আমরা অনেক আইন করেছি। কিন্তু তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারছি না। আগে নানা উপায়ে অর্জিত অর্থ পাচার করা হতো। এখন বিনাশ্রমে লব্ধ ব্যাংক ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে কথিত শিল্পোদ্যোক্তারা বিদেশে দ্বিতীয় বাড়ি বানাচ্ছেন। শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নাম করে এভাবে অর্থ লোপাট ও পাচার কেবল ব্যাংকিং খাত নয়, গোটা অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করবে। যেখানে ২০১৫ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণ যুক্ত হলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্নীতি দমন কমিশনের সহায়তা নিতে বলেছে এবং ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শক্ত হতে বলেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই বা কতটা শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে? বেসিক ব্যাংকের অর্থ লোপাটের মূল হোতাই বা কীভাবে আইনের বাইরে থেকে গেলেন? তাঁর প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, কান টানলে মাথা আসবে। সরাসরি মাথা ধরে টান দিতে সরকারের এতো ভয় কেন?
ক্ষমতায় আসার পর সরকার বিএনপির আমলে বিদেশে পাচার হওয়া কিছু অর্থ ফেরত এনেছিল। সেই উদ্যোগকে দেশবাসী স্বাগতও জানিয়েছিল। কিšুÍ গত কয়েক বছরে এই সরকারের আমলে যে বিপুল অর্থ পাচার হলো, তা উদ্ধারে কোন উদ্যোগ নেই। এমনকি ভারত, পাকিস্তানসহ ২২টি দেশ সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থের তথ্য জানতে চুক্তি করলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এসব কিসের আলামত?”
এখন পাঠকরাই ঠিক করুন এদেশের ভবিষ্যৎ কি হবে।

http://www.dailysangram.com/post/285133-