২৩ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:০৫

লোডশেডিংয়ের কবলে দেশ

চার দিনের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নতি হবে : বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

পিডিবি গতকাল পিক আওয়ারে (সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১১টা) বিদ্যুতের চাহিদা দেখিয়েছে ৯ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন দেখিয়েছে ৯ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট। এ হিসাবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ১৫ মেগাওয়াট বেশি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। গতকাল খোদ রাজধানীতেই দফায় দফায় লোডশেডিং করা হয়েছে। আর রাজধানীর বাইরে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণের মত হলোÑ গ্রামে বিদ্যুৎ যায় না, আসে। বিদ্যুৎ দেয়ার নামে গ্রামের মানুষের সাথে শুধু প্রতারণা চলছে। একে তো দেশব্যাপী ভয়াবহ তাপদাহ, এর ওপর বিদ্যুতের এ ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। আগামী সপ্তাহ থেকে রমজান শুরু হচ্ছে। বিদ্যুতের এমন পরিস্থিতিতে ফুঁসে উঠছে জনগণ। বিদ্যুতের দাবিতে বিভিন্ন জেলায় মিছিল হচ্ছে। তবে আগামী চার দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বর্তমান এ পরিস্থিতির জন্য টাওয়ার ভেঙে যাওয়া, রমজানের জন্য ১০টি পাওয়ার প্লান্ট রণাবেণে থাকা ও গ্যাসের স্বল্পতাকে দায়ী করছেন। তিনি জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলেÑ আগামী চার দিনের মধ্যে রণাবেণে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে। এতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
গতকাল সচিবালয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা সভা শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
বিদ্যুতের এ ভয়াবহ লোডশেডিংয়েল বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক ব্যাংকার বলেন, বিদ্যুতের সঙ্কট মেটাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও সারা দেশে বিদ্যুতের সঙ্কট কাটছে না, বরং এ সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গত কয়েক দিনে খোদ রাজধানীতেই দফায় দফায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে মানুষ। জ্যৈষ্ঠের এ গরমে ইট-বালুঘেরা রাজধানীতে টেকাই দায় হয়ে পড়েছে। সঙ্কট মেটাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অথচ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। লোডশেডিং-মুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। জনগণের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে বিদ্যুতের আতিরিক্ত মূল্যের বাড়তি বোঝা।
পিডিবির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত রোববার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৫৬ কোটি টাকার তেল পোড়ানো হয়েছে। আর গ্যাস পোড়ানো হয়েছে প্রায় আট কোটি টাকার। এ দিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্রিজে থাকা খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। আইপিএস চার্জ না হওয়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বলা চলে মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে সোলায়মান নামক এক বাসিন্দা জানান, গতকাল তাদের এলাকায় কয়েক দফা লোডশেডিং করা হয়েছে। লোডশেডিংয়ের সময় বিকল্প পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে হয় জেনারেটর চালিয়ে; কিন্তু একটানা জেনারেটর চলায় একপর্যায়ে জেনারেটরও বিকল হয়ে পড়ে। তখন পুরোপুরি দুর্ভোগের মুখে পড়েন তারা। অফিসের জরুরি কাজকর্ম ব্যাহত হয়। একপর্যায়ে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। একে তো তীব্র গরম, এর ওপর এ লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা। এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে তাদের দিনাতিপাত করতে হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, বিদ্যুৎ বিভাগের রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন আসলে কোথায় যায় তা বলা মুশকিল। বাস্তবতা হলো, তারা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না।
কলাবাগান থেকে আতাউর রহমান নামক এক বাসিন্দা জানান, সারা দিনের লোডশেডিংয়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। একে তো তীব্র গরম, এর ওপর বিদ্যুৎ না থাকায় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। ফ্রিজে থাকা তরকারি ও মাছ-গোশত নষ্ট হয়ে যায়। একটানা বিদ্যুৎ না থাকায় আইপিএসও একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। সব মিলে এক অসনীয় যন্ত্রণার মধ্যে তাদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
রাজধানীর সোবহানবাগ থেকে এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, দিনে তো একটানা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। কিন্তু সন্ধ্যার পর এ যন্ত্রণা অসনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। একবার লোড শেডিং হলে স্থায়ী হচ্ছে এক দেড় ঘন্টা। তিনি জানান, হাসপাতাল থেকে নবজাতক শিশু নিয়ে বাসায় এসেছেন। বাসায় মেহমান এসেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই। ঘন ঘন বিদ্যুৎ না থাকায় আইপিএসও আর ব্রেকআপ দিতে পারছে না। তিনি নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কী যে এক অসুবিধার মধ্যে সময় পার হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
বিদ্যুতের এ লোডশেডিং শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। গ্রামের মানুষের বক্তব্য হলো, সরকার গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়ার নামে তামাশা করছে। গ্রামে আসলে বিদ্যুৎ যায় না, আসে। একবার বিদ্যুৎ গেলে কয়েক ঘণ্টা থাকে। কিছুক্ষণের জন্য এসে আবার চলে যায়। আর কোনো রকম মেঘের গর্জন শোনা গেলে বিদ্যুৎ চলে যায়। এটা স্থায়ী থাকে চার-পাঁচ ঘণ্টা। সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার আরো কারণ হলো, আগামী সপ্তাহ থেকে রমজান শুরু হচ্ছে। দিনে তো এদিকে ওদিকে কাটানো যায়। সন্ধ্যায় ইফতার, রাতে তারাবি সালাত আদায় করা লোডশেডিংয়ের কারণে কষ্টকর হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাড়ানোর দিকেই অতিরিক্ত নজর দেয়া হচ্ছে; কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের দিকে নজর দেয়া হয়নি। এমনকি সংস্কারকাজও তেমন একটি চোখে পড়ে না। আর এ কারণেই রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবি করা হলেও তার সুফল কিন্তু জনগণ পাচ্ছে না। পিডিবির সাবেক এক চেয়ারম্যান জানান, সাধারণত বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন আগে সংস্কার করা হতো শীতকালে। ঝড়বৃষ্টি আসার আগেই বিতরণ লাইনের ওপর গাছের ডালপালা কেটে ফেলা হতো। বিতরণ লাইন সংস্কার করা হতো। পুরনো তার মেরামত করা হতো। কিন্তু এখন আর সে দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। গুণগত ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাক আর না পাক, একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের আমলারা ঢাকায় থাকেন। তাই গ্রামের কথা কেউ জানতে পারে না। তিনি জানান, কয়েকটি বিশেষ জেলা শহর ছাড়া দেশে প্রায় সব এলাকায়ই বিদ্যুৎ যায় না, বিদ্যুৎ আসে। দিনে-রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য তারা বিদ্যুৎ পান। তিনি মনে করেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে গুণগত ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেই সাথে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সংস্কার ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় বিদ্যুৎ সমস্যা থেকেই যাবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/222311