২৩ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:০০

হঠাৎ হাম বেড়েছে, শিশু মারা যাচ্ছে

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হাম দেখা দিয়েছে। এতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। টিকা নিয়েছে এমন শিশুরও হাম হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, সরকারকে হামের টিকার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গত রোববার ১৬ জন হামের রোগী ভর্তি ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১ জানুয়ারি থেকে ২১ মে পর্যন্ত ৪৬৫ জন হাম নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে সব বয়সের রোগী রয়েছে।
এরই মধ্যে এই হাসপাতালে মারা গেছে ১০টি শিশু। ১৭ মে ১টি, ১৯ মে ২টি, ২০ মে ১টি, এপ্রিলে ১টি এবং মার্চে ৫টি শিশুর মৃত্যু হয়। এদের বয়স ১ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে সেখানে একটি শিশু হামে মারা গেছে।
হামে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত দু-তিন মাসে বেশ কয়েকটি শিশু হাম আক্রান্ত হয়ে তাঁর চেম্বারে এসেছে।
হামে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে হামে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভোলার সিভিল সার্জন রথীন্দ্রনাথ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর বেশ কয়েকজনের হাম হয়েছে। সম্প্রতি তিনজনের রক্তের নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোর বরিশাল, পিরোজপুর, কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ীর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ওই সব জেলাতেও হামে আক্রান্ত হয়ে অনেকে চিকিৎসকদের কাছে আসছে।
গতকাল সোমবার মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে পরিস্থিতি দেখতে গেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নার্স প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এই হাসপাতালে ১৮ বছর কাজ করছি। এত হামের রোগী আগে দেখিনি।’ তিনি জানান, হাম ওয়ার্ডে ২৫টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো দিন রোগী আসছে শয্যাসংখ্যার চেয়েও বেশি।
পঞ্চমতলার ওই ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন গেন্ডারিয়ার মুদি দোকানদার আরমান তালুকদার। তাঁর হাত, পা, বুক, পেট, পিঠ, মুখ, ঠোঁট ছোট ছোট লাল গুটিতে ভরা। হাঁটতে, বসতে, শুতে কষ্ট হয় তাঁর। কথা বলতেও কষ্ট হয়। আরমানের স্ত্রী বলেন, পাড়ার চিকিৎসক এই হাসপাতালে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। আরমান ও তাঁর স্ত্রী জানেন না, আরমান ছোটবেলায় হামের টিকা নিয়েছিলেন কি না।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মোছাম্মৎ লাইজির ছেলের হাম উঠেছে। ছেলের বয়স ৮ মাস ২০ দিন। ইতিমধ্যে ছেলেকে চারটি টিকা দিয়েছেন। কিন্তু হামের টিকা দেওয়া হয়েছে কি না, তা জানেন না। কবে দিতে হয়, তাও জানেন না। কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার কেয়া বেগম তাঁর ১০ মাসের ছেলেকে নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। মা-সন্তান দুজনেরই হাম উঠেছে। কেয়া বেগম জানেন না ছোটবেলায় তাঁকে হামের টিকা দেওয়া হয়েছিল কি না। তবে নিজের ছেলেকে এখনো টিকা দেননি।
হাসপাতালের কাছেই সাততলা স্টাফ কোয়ার্টারে মা-বাবার সঙ্গে থাকে ছয় বছরের পারভেজ খান। ৯ ও ১৫ মাস বয়সে তাকে টিকা দেওয়া হয়েছিল। গত শুক্রবার হাম নিয়ে সে হাসপাতালে আসে। কর্তব্যরত নার্স বললেন, ওর টিকা নেওয়া আছে বলে শরীরের গুটিগুলো অন্যদের মতো মারাত্মক নয়।
টিকা পূর্ণ সুরক্ষা দেয় না
বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) বাস্তবায়িত হয় মাতৃ, নবজাতক, শিশু ও কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায়। এই কর্মসূচির পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর কিছুসংখ্যক শিশু টিকার বাইরে থেকে যায়। এরা হামের ঝুঁকিতে থাকে। এ ছাড়া টিকা দেওয়ার পরও ১৫ শতাংশ শিশুর সঠিক প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে না। তাঁর মতে, প্রতিবছর প্রায় ১৮ শতাংশ শিশু হামের ঝুঁকিতে থাকছে এবং এদের সংখ্যা পুঞ্জীভূত হচ্ছে।
ইপিআই কর্মকর্তারা বলছেন, শিশুর বয়স ৯ মাস বা ২৭০ দিন হলেই প্রথম ডোজ এমআর (হাম ও রুবেলা) টিকা দিতে হয়। দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিতে হয় বয়স ১৫ মাস হলে। গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি পুরোনো ওয়ার্ডে সাতটি টিকাদান কেন্দ্রে ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশুদের টিকা দেন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী। প্রতিটি কেন্দ্র মাসে একবার যান মাঠকর্মীরা।
মো. জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, ‘গ্রামে টিকা কার্যক্রম ভালো চলছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্ভর করতে হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ওপর। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কিছু দুর্বলতার কারণে শহরাঞ্চলে ইপিআই দুর্বল। হামের রোগী শহরেই বেশি।’ তিনি বলেন, নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির বাইরে প্রতি তিন-চার বছর পরপর সারা দেশে জাতীয়ভাবে হামের টিকার গণ ক্যাম্পেইন হয়। সর্বশেষ গণ ক্যাম্পেইন হয়েছিল ২০১৪ সালে। এ বছর শেষের দিকে জাতীয়ভাবে ক্যাম্পেইন করার পরিকল্পনা আছে।
সর্বশেষ ইপিআই সুরক্ষা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে (২০১৫) দেখা যায়, ৯০ দশমিক ১ শতাংশ শিশু হামের টিকা পায়। গ্রামে এই হার ৯১ দশমিক ১ এবং শহরে ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ। কাভারেজ সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে, ৯৫ দশমিক ১ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
সমাধান খুঁজতে হবে
রাজধানীর মিরপুরের ডা. এম আর খান চিলড্রেন হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের যুগ্ম পরিচালক এন কে ঘোষ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রোগী বেশি হওয়ার কারণে হাসপাতালে পৃথক ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে নয় মাস বয়সে শিশুদের টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু হাম নিয়ে অনেক শিশু আসছে, যাদের বয়স নয় মাসের কম। কিছু শিশু আসছে, যারা দ্বিতীয় টিকা নেয়নি। কিছু শিশু কোনো টিকাই নেয়নি। তিনি বলেন, ‘সরকারকে বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। টিকা কর্মসূচির সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে।’
এ ব্যাপারে শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, হঠাৎ হাম দেখা দেওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি, ইপিআই এবং পেশাজীবী সংগঠন একসঙ্গে বসে সমাধান খুঁজতে হবে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1189941/