২৩ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৫১

ভরা মৌসুমেও আরেক দফা বাড়ল চালের দাম

পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন মিল মালিকরা

রাজধানীর বাজারে বোরোর নতুন চাল আসছে। অতীতে সব সময় দেখা গেছে, নতুন চাল উঠলে দাম কমে। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। দাম তো কমেইনি বরং আরেক দফা বেড়েছে। গত দুই মাসে তিন দফা বেড়েছে চালের দাম। ব্যবসায়ীদের যুক্তি, বন্যার কারণে বোরোর ফলন কম। এ কারণে ধানের দাম বেশি। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে চালের মিলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়ছে দামে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের মজুদ কম থাকায় মিল মালিকরা নানা কৌশলে এর সুযোগ নিচ্ছেন। তারা ঘন ঘন চালের দাম বাড়াচ্ছেন।

গত দু'দিনে রাজধানীর খুচরা বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে গড়ে দুই টাকা বেড়েছে। এখন এক কেজি মোটা গুটি বা স্বর্ণা চাল কিনতে দিতে হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা। এ ছাড়া পাইজাম চাল ৪৯ থেকে ৫০ টাকা ও বিআর-আটাশ ৫১ থেকে ৫২ টাকা, মিনিকেট ৫৪ থেকে ৫৭ টাকা ও নাজিরশাইল ৫৪ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সুগন্ধি চালের দামও কেজিতে গড়ে ৮ টাকা বেড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মোটা চালের দাম গত দু'বছরে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে। গত এক যুগের মধ্যে এখন চালের দাম সর্বোচ্চ। মিরপুর-১ নম্বরের খুচরা চাল ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন সমকালকে বলেন, নতুন চালের দাম সবাইকে অবাক করেছে। সব সময় ক্রেতারা অপেক্ষায় থাকেন নতুন চাল কম দামে পাবেন। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। পাইকারি বাজারে বেড়ে যাওয়ায় তারা বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন- জানালেন এ বিক্রেতা।

পাইকারি বাজারে এক সপ্তাহ ধরে বাড়ছে চালের দাম। মিল থেকে বাড়তি দামে আনতে হচ্ছে- এ কারণে কেজিতে গড়ে দুই টাকা দাম বাড়ছে বলে জানান পাইকারি ব্যবসায়ীরা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। মিনিকেট ৫১ থেকে ৫৪ টাকা, নাজিরশাইল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, বিআর-আটাশ ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা ও পাইজাম ৪৬ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সমকালকে বলেন, ক্রেতা এবং কৃষক উভয়ের স্বার্থ সমন্বয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতির সুস্পষ্ট হিসাব থাকতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও মজুদ যথেষ্ট

কি-না যাচাই করে দেখা উচিত। সরকার আমদানির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সঠিক। কৃষকদের ধানের দাম ঠিক রেখে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানি ও মজুদ পর্যাপ্ত থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বন্যা ও ব্লাস্ট রোগে ধানের ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া সরকার চাল বিতরণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের হাতে মজুদ কম রয়েছে। মিল মালিকরা এর সুযোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের মজুদ বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তাহলে চালের দাম স্বাভাবিক হবে।

রাজধানীর বড় চালের আড়ত বাদামতলীর পাইকারি ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কাওসার আলম খান সমকালকে বলেন, এবার ধানের দাম বেশি। তাছাড়া মিলগুলো ঠিক মতো উৎপাদনে থাকতে না পারায় পর্যাপ্ত চাল সরবরাহ করতে পারছে না। তিনি বলেন, এবার বন্যার কারণে বোরো মৌসুমে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ চাল উৎপাদন কম হবে। এ কারণে আগেভাগে ধান কেনার হিড়িক পড়েছে। এতেই ধানের দাম বেড়ে গেছে। কাওসার আলম খান বলেন, সরকারের চাল সংগ্রহের সুফল পাচ্ছেন না কৃষকরা। এর সুফল নিচ্ছেন মিল মালিকরা। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনলে তারা সুফল পেতেন। যদিও এতদিন মিলাররা ধান কিনে সব সময় কেজিতে ১০ টাকা মুনাফা করেছেন। এবার মুনাফা কমে যাওয়ায় সরকারকে চাল দিতে চাচ্ছেন না মিলাররা।

বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রাশিদ সমকালকে বলেন, ধানের বাজার বেড়েই চলছে। এ দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা জানেন না তারা। শুরুতে এক হাজার টাকা মণ ধান কিনলেও এখন ভেজা ধান এক হাজার ১০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। গত বছরের এ সময়ে ধানের মণ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ছিল। তিনি বলেন, এখন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অল্প অল্প ধান উঠছে। এ ধান পুরোপুরি উঠলে চালের দাম স্থিতিশীল হবে। তবে ভরা মৌসুমে চালের বাজার বৃদ্ধি- এটা অস্বাভাবিক। কয়েক যুগের মধ্যে এবারই প্রথম মৌসুমে চালের দাম বাড়ল। আবদুর রশিদ বলেন, মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির কারণে উৎপাদন বন্ধ ছিল। এখন মিল চালু হলেও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি দিন ৭ থেকে ১০ ঘণ্টা মিল বন্ধ থাকছে। এ কারণে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের চাল সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে দেড় লাখ টন চাল মিল থেকে সরকারকে সরবরাহ করা হবে। এর পরও বেশিরভাগ মিল চড়া দামে ধান কিনে ৩৪ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহ করতে পারবে না। এ জন্য আলাদা প্রণোদনা দিলে পুরো চাল সংগ্রহ করতে পারবে সরকার।

দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়। এর প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুমে। গত মৌসুমে ১ কোটি ৮৯ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদিত হয়। এ বছর বৃষ্টিতে বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় পাকা ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে চালের উৎপাদন ৫ থেকে ৬ লাখ টন কম হতে পারে। এতে মৌসুমের শুরুতেই চড়া দামে ধান কিনতে হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। সরকার এরই মধ্যে চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

http://bangla.samakal.net/2017/05/23/294951#sthash.bAYX2dBS.dpuf