২ জুন ২০২৪, রবিবার, ১০:৫১

ত্রিমুখী চাপে বাজেট ব্যবস্থাপনা

সরকার পরিচালনা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বিপুল ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না রাজস্ব আয়। এ কারণে জাতীয় বাজেটে বেড়েই চলেছে ঘাটতির পরিমাণ। আয়-ব্যয়ের এই ব্যবধান ঘোচাতে বাড়ছে সরকারের ঋণ। ঘাটতির পরিমাণ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, মোট বাজেটের তিন ভাগের এক ভাগই এখন ঋণনির্ভর। আবার দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আয়ের তুলনায় ব্যয়ের অতিরিক্ত চাহিদা, ঘাটতি মেটাতে বিপুল পরিমাণ ঋণের সংস্থান এবং সুদ-আসল পরিশোধে বিশাল ব্যয়ের বোঝা—ত্রিমুখী এই চাপে বাজেটের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতি বছর বাজেটের আকার যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী রাজস্ব আদায় বাড়ানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে হিসাব শুরুর পর আট বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার দ্বিগুণ হয়েছে।
ওই বছর (২০১৫-১৬) চলতি বাজারমূল্যে জিডিপি ছিল ২০ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। গত (২০২২-২৩) অর্থবছরে তা ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
দেশের অর্থনীতির আকার ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও সেই তুলনায় রাজস্ব আয় বাড়াতে পারেনি সরকার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই অঙ্ক জিডিপির ৯.৬৮ শতাংশ। শুধু কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য, আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা হতে পারে, যা জিডিপির ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ। এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে কর আদায়ের লক্ষ্য হবে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে নতুন বাজেটে ঘাটতি হবে ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

বাজেটের আকার ও রাজস্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও সরকারের আয়-ব্যয়ের বিন্যাস বা গতি-প্রকৃতি বদলাচ্ছে না। সাধারণত মধ্যম আয় বা উন্নয়নশীল দেশে বাজেটের আকার জিডিপির ২০ শতাংশের ওপরে থাকে। কোথাও কোথাও ২৫ বা ৩০ শতাংশও থাকে। আর করের অনুপাত থাকে জিডিপির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ এই দুই জায়গায় খুবই পিছিয়ে আছে। এদেশে বাজেটের আকার চলতি মূল্যে জিডিপির ১৮ থেকে ১৯ শতাংশের বেশি হবে না। আর কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচেই রয়ে গেছে। ফলে কর কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে হবে, কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে হবে, করের ভিত্তিকে বদলাতে হবে এবং করের অনুপাত জিডিপির ২০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। আর সেটা নিয়ে যেতে পারলে বাজেটের আকারও জিডিপির ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।’

সরকারের আয় বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে গতানুগতিক পন্থা অনুসরণ করছে। সেটা হলো ভ্যাটসহ পরোক্ষ কর বাড়ানো। কিন্তু রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ করের অবদান এরই মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রগতিশীল আয়কর ও প্রো-সম্পদ কর আরোপ করে ধনীদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করতে না পারলে, তা দুটো দিক থেকে ক্ষতিকর হবে। একটি হলো, বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকবে এবং আয় ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন হতে থাকবে। আরেকটি, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের গণ্ডি পার হতে পারবে না।’

পরিসংখ্যান বলছে, রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়াতে না পারায় প্রতিবছর বাজেটে চেপে বসছে বড় অঙ্কের ঘাটতির বোঝা। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম (২০০৯-১০) অর্থবছরে ১ লাখ ১০ হাজার ৫২০ কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ঘাটতির এই অঙ্ক তখনকার জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এতে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। হিসাব করে দেখা গেছে, ১৫ বছরে বাজেটের আকার ৬ দশমিক ৮৯ গুণ বাড়লেও ঘাটতি বেড়েছে ৮ দশমিক ৮৪ গুণ।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ধরে নেওয়া হয়। আমাদের এখানেও সেটা ধরে নেওয়া হচ্ছে। কমাতে পারলে ভালো। কিন্তু যখন আমি এগোতে চাইব, তখন তো অর্থ লাগবে। এখন যাদের কর দেওয়ার কথা তারা যদি না দেয়, তাহলে তো বাজেট ঘাটতি বাড়বেই। ধনী যারা আছেন, তাদের অনেকেই সঠিকভাবে কর দেন না। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে কর আদায় বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের অনেক কাজ করার আছে।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের বাজেটে যে করেই হোক, ৫ শতাংশের বেশি ঘাটতি হচ্ছে না। এবারও হয়তো সরকার এদিক-সেদিক দেখিয়ে সেটাই করবে। কিন্তু ১ লাখ কোটি টাকার ৫ শতাংশ আর ৮ লাখ কোটি টাকার ৫ শতাংশ তো এক নয়। সুতরাং বাজেটের আকার যেহেতু বিশাল তাতে ঘাটতির পরিমাণও বিশাল হবে।’

বাজেটের ঘাটতি পূরণে সরকার দেশি ও বিদেশি উৎস ঋণ নেয়। ঘাটতির অঙ্ক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় প্রতিবছর বেড়েই চলেছে ঋণের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি উৎস থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৯ লাখ ৩২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা ধরে)। আর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। বাজেটের বড় অংশই বিপুল পরিমাণ এই ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, শুধু সুদ পরিশোধেই আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছরে ঋণ পরিশোধেই চলে যাবে বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ টাকা।

পরিসংখ্যান বলছে, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ২০২ কোটি ডলার। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে ২৭৯ কোটি ডলার ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম ৯ মাসেই (জুলাই-মার্চ) এই অঙ্ক ২৫৭ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৯ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে শেষ পর্যন্ত এই ব্যয় ৩২৮ কোটি ডলারে দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই অঙ্ক দাঁড়াবে ৪১৮ কোটি ডলারে।

অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ উৎসের ঋণের ক্ষেত্রে বেড়েছে ব্যাংকনির্ভরতা। আগে সরকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করত। তবে নানা শর্ত বেঁধে দেওয়ায় সেখানে আর আগের মতো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। চলতি বাজেটে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আগামী অর্থবছরে এই অঙ্ক দাঁড়াবে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট তৈরি হয় এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কমে যায়। অন্যদিকে প্রতিবছর ঋণ বাড়তে থাকায় সুদ ও আসল পরিশোধের চাপে পড়ছে সরকার। ঘাটতি ও ঋণের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সহনীয় পর্যায়ে নামাতে না পারলে আগামীতে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।

সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে সাবেক অর্থ সচিব সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘বাজেটের ওপর এই চাপ এক বা দুই বছরে সৃষ্টি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে নানা ভুল পদক্ষেপ, অব্যবস্থাপনা, অপচয় ও দুর্নীতির কারণে সরকারের আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে। বাজেট করতে হবে সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে। যেটা করার সক্ষমতা আপনার নেই, সেটা করতে গেলে তো আপনি বিপদে পড়বেন। বিশেষ করে ঋণ করে যদি সেটা করা হয়।’

সুদ পরিশোধের চাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যে ঋণ নেওয়া হতো তার জন্য সুদ দিতে হতো না, সামান্য সার্ভিস চার্জ দিলেই হতো। এখন বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক-এডিবির কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হলে টাকাটা যথাযথভাবে ব্যয় করা হচ্ছে কি না, সেটি তারা মনিটরিং করে। আর দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে যে পরিমাণ টাকা দরকার, তার চেয়ে বেশি খরচে উৎসাহিত করা হয়। কারণ এতে যে-ই ঋণ দেয়, তাদের লাভ। এতে অপচয় ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। আর অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ে।’

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখান থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লাগবে। তবে প্রচেষ্টা এখনই শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম পথ হলো রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে কর অব্যাহতি দেওয়া আছে, এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, কর আদায়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ফাঁকি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে বাজেট ব্যয়ের দিক থেকেও দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করতে হবে।’

https://www.kalbela.com/ajkerpatrika/firstpage/93031