২২ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:২১

সরকারের শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ব্যবধান বাড়ছে

প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত কমতে থাকলেও মাধ্যমিকে প্রতিবছরই তা বাড়ছে। মাধ্যমিকে ২০১১ সালে গড়ে ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক ছিলেন। পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালে এসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত বেড়েছে। এখন ৪২ জন শিক্ষার্থীর জন্য গড়ে ১ জন শিক্ষক রয়েছেন।

সরকারের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১৬’ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষকের সংখ্যাও নির্ধারিত কোটার চেয়ে কম। এ ছাড়া শিক্ষার এই স্তরে শিক্ষার্থী, বিশেষ করে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক। প্রায় ৪২ শতাংশ ছাত্রী ঝরে পড়ে।

গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর ব্যানবেইস ভবনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান শামসুল আলম। প্রতিবেদনে মাধ্যমিক স্তরে বেশ কিছু ইতিবাচক দিকের উন্নতিও হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, মাধ্যমিকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের হার এক বছরের ব্যবধানে কিছুটা বেড়েছে, ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বিন্দু। তবে এখনো ২৯ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাননি। এ ছাড়া ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট, নিরাপদ পানি, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, মাল্টিমিডিয়া সুবিধা ক্রমে বাড়ছে। বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এখন এই সুবিধা আছে।

সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, আগামী বছরের মধ্যে মাধ্যমিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ৩০ করার কথা রয়েছে। শিক্ষার গুণগত মানের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই অনুপাত কমার পরিবর্তে প্রতিবছরই বাড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষা তাঁদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ আরও বেশি চ্যালেঞ্জ। এটা ঠিক যে এই স্তরে ঝরে পড়ার হার এখনো বেশি। আগে আরও বেশি ছিল।
নারী শিক্ষক কম
২০০৯ সালের মে মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) নারী শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। এতে অন্তত ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষক নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য বলছে, এই কোটা পূরণ হচ্ছে না। মাধ্যমিকে মোট বিদ্যালয়ের প্রায় ৯৫ ভাগই বেসরকারি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্য এমন কোটা নেই।
২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যানবেইসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ছয় বছরে প্রাথমিক-পরবর্তী শিক্ষার স্তরে নারী শিক্ষকের হার মাত্র আড়াই শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক-পরবর্তী শিক্ষার স্তরে মোট শিক্ষকের মধ্যে নারী ২২ দশমিক ১০ শতাংশ। বাকি সবাই পুরুষ। আলাদাভাবে মাধ্যমিক স্তরে নারী শিক্ষকের হার ২৫ শতাংশের কিছু বেশি। তবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক এখন নির্ধারিত কোটার চেয়ে বেশি (৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ)। শিক্ষার এই স্তরে ৬০ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে।
৪২ শতাংশ ছাত্রী ঝরে পড়ছে
মাধ্যমিকে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রী ভর্তি হয় বেশি। ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হারও বেশি। এখন মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ৪২ শতাংশ ছাত্রী দশম শ্রেণি শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে। অবশ্য এই হার এক বছরের ব্যবধানে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
এ বিষয়ে ব্যানবেইসের কর্মকর্তা শামসুল আলম আগের একটি গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, বাল্যবিবাহ এর অন্যতম কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, অষ্টম শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি ছাত্রীর বিয়ে হয়। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তাসহ আরও কিছু কারণ আছে।
মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার গড় হার ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। তবে মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছালে এই হার কমে। উচ্চমাধ্যমিকে ২০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। তবে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার প্রায় ২৪ শতাংশ। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৯ শতাংশের কিছু বেশি।
কারিগরিতে শিক্ষার্থী কমছে
সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশকে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে এই হার কমেছে। ২০১৫ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সেটা ২০১৬ সালে সামান্য কমে হয়েছে ১৩ শতাংশ।
সরকারের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, মাধ্যমিকে শিক্ষকের যে তথ্য উঠে এসেছে, তা ইতিবাচক নয়। এই স্তরে দক্ষ শিক্ষকের অভাব খুব বেশি। বিশেষ করে ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক-সংকট বেশি, যা গুণগত শিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে। তাঁর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, মাধ্যমিকের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। এগুলোতে নানা ধরনের সমস্যা আছে। ফলে ঠিকমতো যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হয় না।
মাধ্যমিকে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হারকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বাল্যবিবাহ এর বড় কারণ। পারিবারিক ব্যয় ও নিরাপত্তার অভাব থেকেও অনেক মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়ে যায় বলে তাঁর পর্যবেক্ষণ।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1188541/