২২ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:১৪

সাগর জরিপে গোড়ায় গলদ

ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’ ২৮ বছর পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিশাল মৎস্যভান্ডার জরিপে জটিলতা
বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তীর্ণ পানিসীমায় এবং ২শ’ নটিক্যাল মাইল মহিসোপান নিয়ে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) উপর বাংলাদেশের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বলিষ্ঠ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সফলতার অনন্য নজির। দেশের সমুদ্রসীমায় মৎস্যভান্ডার ও বিভিন্ন সম্পদরাজির মজুদ (স্টক) সম্পর্কে নিরবচ্ছিন্ন জরিপ এবং গবেষণার লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যা দীর্ঘ ২৮ বছর পর এক যুগান্তকারী উদ্যোগ।
তবে বাস্তবতার আলোকে সেই জরিপ ও গবেষণা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ হলো স¤প্রতি সংগৃহীত জরিপ-গবেষণা জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’র বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা। যা গবেষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছেই অপ্রত্যাশিতভাবে ধরা পড়েছে। এতে করে দীর্ঘদিন পর দেশের সমুদ্রসীমায় জরিপ ও গবেষণা গোড়ায় গলদের কারণে পড়তে যাচ্ছে জটিলতার মুখে। এ নিয়ে চলছে কর্তাব্যক্তিদের দৌঁড়ঝাপ। প্রসঙ্গত ‘আরভি মীন সন্ধানী’ নামক জরিপ ও গবেষণা জাহাজটি ৬৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়। গত বছরের ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বোট ক্লাবে আয়োজিক এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাহাজের কমিশনিং করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, জাহাজটি প্রত্যাশিত বøু-ইকোনমি (সামুদ্রিক অর্থনীতি) বাস্তবায়ন এবং বিশাল সমুদ্র এলাকার জীববৈচিত্রের জরিপ ও মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু ‘আরভি মীন সন্ধানী’ উদ্বোধনের পর থেকে যেখানে সামুদ্রিক জরিপ-গবেষণায় ধারাবাহিক এবং সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকার কথা সেখানে পদে পদে জাহাজটির ত্রæটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি ধরা পড়ছে। জাহাজের ডিজাইনেও রয়েছে ত্রুটি। এ ধরনের জরিপ-গবেষণা জাহাজে দু’টি ইঞ্জিন থাকারই কথা। কিন্তু এ জাহাজে একটি মাত্র ইঞ্জিন রয়েছে। উপকূলভাগ থেকে ২শ’ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত গভীর বঙ্গোপসাগরে গিয়ে একটি ইঞ্জিন নিয়ে জরিপ ও সরেজমিন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা বেশ কঠিন এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাও অনেক সময়ই বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে এ ধরনের জাহাজকে গভীর সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়। এক্ষেত্রে ‘মীন সন্ধানী’র কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কেননা গভীর সমুদ্রযাত্রায় জাহাজের একটি ইঞ্জিন যে কোনো সময়ই বিকল হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এ জাহাজটির ড্রাফট এবং ওজনও কম। এর ড্রাফট মাত্র ৩ দশমিক ২ মিটার।
অথচ ইতোপূর্বে সমুদ্রে জরিপ-গবেষণা পরিচালনাকারী জাহাজ ‘আর ভি অনুসন্ধানী’র ড্রাফট ছিল ৩ দশমিক ৮ মিটার। ৩ দশমিক ২ মিটার ড্রাফট, ৩৮ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৯ মিটার প্রস্থ নিয়ে ‘মীন সন্ধানী’র গভীর সাগরে চলাচল ও জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। সাগরে ঢেউয়ের তোড়ে এ জাহাজটি প্রবলভাবে দোল খায়। গভীর সমুদ্রে এ ধরনের জাহাজের যে কোনো আবহাওয়ার পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক চলাচল ও জরিপ-গবেষণা কার্যক্রম যথাযথ পরিচালনার জন্য জাহাজের ওজন ১২শ’ থেকে ১৫শ’ মেট্রিক টন প্রয়োজন। কিন্তু মীন সন্ধানীর ওজন মাত্র ৬শ’ মেট্রিক টন। জাহাজটিতে কাজ করতে পারেন ২৮ জন গবেষক ও নাবিক। মূল ইঞ্জিনের ক্ষমতা ১৪শ’ হর্স পাওয়ার, ১৮শ’ আরএমপি।
এ অবস্থায় জাহাজটি থেকে সাগরে জরিপ-গবেষণার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিগত ফেব্রুয়ারি’১৭ইং মাসে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের উপস্থিতিতে জাহাজটির বেহালদশা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কিন্তু কোনো সুরাহা বেরিয়ে আসেনি। এর পেছনে দায়ী কারা তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়েও কোনো দিক-নির্দেশনা আসেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘আরভি মীন সন্ধানী’ গভীর সমুদ্রে চলাচল করতে গিয়ে পদে পদে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক বা কারিগরি সমস্যার কারণে জাহাজটি জরিপ কার্যক্রমের চেয়ে মেরামতি কাজেই বেশি সময় পার করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের পানিসীমায় সাগরের তলদেশে বিভিন্ন জাত-প্রজাতির মৎস্য সম্পদের বিচরণশীলতা, সমুদ্রের কোন কোন পয়েন্টে পানির কোন স্তরে কী কী ধরনের মাছ রয়েছে, মাছের খাদ্য-শৃঙ্খল কোথায় রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে সরেজমিন জরিপের জন্য বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। উক্ত প্রকল্পের আওতায় দরপত্রের মাধ্যমে ‘আরভি মীন সন্ধানী’ জরিপ ও গবেষণা জাহাজ কেনা হয়। ২০১২ সালে জাহাজটির কার্যাদেশ দেয়া হয়। ২০১৪ সালের জুনে বাংলাদেশ থেকে একটি কারিগরি টিম জাহাজটি দেখতে যায়। এ টিমের একটি প্রতিবেদনে জাহাজটির ডিজাইনে ত্রæটিসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এতে এ জাহাজ দিয়ে সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ জরিপ-গবেষণা কার্যকর হবে না মর্মে উল্লেখ করা হয়। তবে তাকে পাশ কাটিয়ে জাহাজটি ২০১৬ সালের ৯ জুলাই দেশে নিয়ে আসা হয়।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ‘আরভি মীন সন্ধানী’র সাহায্যে বিশাল ও বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের মৎস্য ভান্ডার সেই সাথে তেল গ্যাসসম্পদ, শামুক, ঝিনুক, শেওলা, প্রবালসহ সামুদ্রিক সম্পদরাজির তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা। জাহাজটিতে ‘সনার’ যন্ত্রটি থাকলেও বঙ্গোপসাগরের ১৬শ’ মিটার গভীরের সব তথ্য এ জাহাজের মাধ্যমে পাওয়া যাবে কিনা। সঠিক তথ্য মিলবে কিনা অর্থকরী চিংড়িসহ মৎস্যসম্পদের মজুদ সম্পর্কে। যার মধ্যদিয়ে বেরিয়ে আসবে কিনা মৎস্যসম্পদের সর্বোচ্চ আহরণ সীমা (ম্যাক্সিমাম সাসটেইনএবল ইয়েলডিং- এমএসওয়াই) বিষয়ে সঠিক গাইডলাইন। সমুদ্রের পানিতে ৩৬০ ডিগ্রি অবতলে ২শ’ মিটার গভীরতা পর্যন্ত জীবিত যেকোনো জলজ প্রাণী চিহ্নিত করতে সমর্থ হবে কিনা ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞ সূত্র মতে, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) ষাটের দশকে বঙ্গোপসাগরে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ জরিপ-গবেষণা পরিচালনা করে। এ জরিপে বঙ্গোপসাগরকে অভিহিত করা হয় ‘মৎস্য খনি’ হিসেবে। বাংলাদেশের পানিসীমা মাছসহ সামুদ্রিক সম্পদে সুসমৃদ্ধ। সাগরে মূল ৩টি মৎস্য বিচরণ এলাকা হলো ‘সাউথ প্যাসেচ’, ‘মিডলিং’ বা ‘মিডল গ্রাউন্ড’ এবং ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ হিসেবে পরিচিত। যেখানে মজুদ ও বিচরণশীল রয়েছে রুপচান্দা, কালাচান্দা, কোরাল, ইলিশ, লাক্ষা, ছুরি, পোয়া, লইট্টা, মাইট্টা, চিংড়ি ও টুনাসহ হরেক প্রজাতির অর্থকরী মাছ। সাগরে মাছ শিকার হচ্ছে নির্বিচারে। অগভীর অংশে মাছ বেশিহারে ধরা হলেও গভীর সমুদ্রের দিকের মাছ (টুনা জাতীয়) কম আহরণ হচ্ছে। এতে করে সাগরে মাছের ভারসাম্যহানি ঘটছে।
অপার সম্ভাবনার খনি বঙ্গোপসাগর। বিশাল পানিরাশির মাঝে প্রধান যে সম্পদ বঙ্গোপসাগর ধারণ করে আছে তাতে রয়েছে হরেক জাতের মাছ, মুক্তা, প্রবাল, ঝিনুক অন্যতম। সাগরে আছে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। অর্থকরী ৪৭৬ প্রজাতির মাছ। অথচ মিঠাপানির মাছ মাত্র ২৫০ জাতের। প্রাণিজ প্রোটিনের বিরাট অংশের যোগান আসে সাগরের মাছ থেকেই। বর্তমানে সমুদ্রসীমা সুনির্ধারিত থাকায় সেখানে মাছের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা সম্ভব। দেশের পানিসীমা বেড়েছে। ফিশিং জোনও ৫-৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাগরে প্রচুর পরিমাণে মাছ আহরণ করে রফতানি ও দেশে আমিষের চাহিদা মেটানো সম্ভব। সামুদ্রিক মৎস্যখাতে বিনিয়োগ অদূর ভবিষ্যতে আরও লাভজনক বিবেচিত হবে।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রসম্পদ বিজ্ঞানীরা বঙ্গোপসাগরকে অতীতকাল থেকেই ‘সুসমৃদ্ধ খনি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৫৮ সালে জাপানি গবেষণা ও সমুদ্র অনুসন্ধানী জাহাজ ‘খুশি মারো’ যোগে প্রথম জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এরপর ১৯৬০ সালে ‘কাগাওয়া মারো’ থেকে শুরু করে ১৯৮৪-৮৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ‘অনুসন্ধানী’ নামক জরিপ জাহাজে বাংলাদেশের সন্নিহিত বঙ্গোপসাগরে বিশাল মৎস্য ভান্ডারের মজুদ, স্থিতি ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিরূপন করা হয়। গবেষণা জাহাজযোগে এসব জরিপে বেরিয়ে এসেছে, চিংড়ি, ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছে ভরপুর বঙ্গোপসাগর। এটি মাছের বংশ বৃদ্ধি ও দ্রুত বর্ধনের উর্বর ক্ষেত্র।
বেপরোয়া মাছ শিকার নিয়ন্ত্রণ, পোনা নিধন বন্ধ, পরিবেশ দূষণ রোধ, মাছের বিচরণ এলাকা বা অভয়াশ্রম সংরক্ষণ করা হলে বাংলাদেশ শুধুই তার সামুদ্রিক মাছ দিয়েই সবল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। কক্সবাজারের টেকনাফ সেন্টমার্টিন শাহপরীর দ্বীপসহ সমগ্র উপকূল, দ্বীপসমূহ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চট্টগ্রামের বহির্নোঙর থেকে শুরু করে আনোয়ারা, বাঁশখালী, স›দ্বীপ চ্যানেল, হাতিয়া, রামগতি, নিঝুমদ্বীপ, ভোলা, চরফ্যাশন, বরগুনা, পাথরঘাটা, চরকুকরি মুকরি, সুন্দরবন, দুবলার চরাঞ্চল, রায়মঙ্গল এবং এর সংলগ্ন সমুদ্র উপকূলের আশপাশ জুড়ে ইলিশ, চিংড়িসহ মজুদ রয়েছে মূল্যবান মৎস্য সম্পদ। তবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলের দিকে মাছ শিকার অর্থাৎ কোস্টাল ফিশিং মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে মৎস্যসম্পদের স্বাভাবিক মজুদ বা স্থিতিশীলতা বর্তমানে হুমকির মুখে।

https://www.dailyinqilab.com/article/80516/