২২ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:১০

কর্তব্যে অবহেলার শাস্তি থাকলেও মগবাজার ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রে তা উপেক্ষিত

মালিবাগ-মৌচাক সড়কে দুর্ভোগ যেন মানুষের নিত্যসঙ্গী। যত্রতত্র এবড়ো-থেবড়ো গর্ত। তাও আবার পানিতে ভরা। পানির নীচে গর্ত ছোট না বড় তা বোঝার কোন উপায় নেই। বিকল্প না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছে সাধারণ মানুষ। কবে ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষ হবে তার যেমন কোন নিশ্চয়তা নেই তেমনি এই দুর্ভোগ থেকে নগরবাসী কবে নিষ্কৃতি পাবে তারও ঠিক নেই। ফ্লাইওভার নির্মাণকালে নীচ দিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার বাজেট বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। দুর্নীতির রা-গ্রাসে কতিপয় উপরতলার মানুষের পকেট ভারি হওয়া কিন্তু থেমে নেই। থেমে আছে শুধু মানুুুষের দুর্দশা লাঘবের পদক্ষেপ। 

এই সড়কে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে ইট,বালু, খোয়া, রডসহ নির্মাণসামগ্রী। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলোর মুখ ভরাট হয়ে গেছে নির্মাণ সামগ্রী ও আবর্জনায়। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে হাঁটু পানি জমে যায়। বৃষ্টি ছাড়াও নির্মাণকালীন ব্যবহৃত পানিতে ডুবে থাকছে রাস্তা। অন্যদিকে কোন প্রকার নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া উঁচু পিলারের ওপর ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলছে। অসতর্ক কাজের কারণে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। বিকল্প উপায় না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খানাখন্দে ভরা জলাবদ্ধ এ সড়কে চলাচল করছেন রাজধানীবাসী।
এদিকে বর্ষাকাল না আসতেই কয়েক দিন আগে সামান্য বৃষ্টিতে একরকম তলিয়ে যায় মালিবাগ-মৌচাক সড়কের পুরোভাগ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে আগামী জুন-জুলাই ভরা বর্ষাকাল শুরু হলে কী হবে। এখনই মালিবাগ-মৌচাক সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে বাস মিনিবাসের। প্রাইভেটকার, সিএনজি ভুলেও এ পথে যেতে চায় না। রিকশা চলাচল তো আরও বিপজ্জনক। আর সাধারণ পথচারীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। অথচ সীমাহীন জনদুর্ভোগ লাঘবে কারও কোনো নজর নেই। নিয়ম থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফ্লাইওভারের নিচে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করা দূরের কথা, উল্টো ধাপে ধাপে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করে মহলবিশেষ লাভবান হয়েছে এবং হচ্ছে। অসতর্কতা ও কর্তব্যে অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। আর এটা নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় এড়িয়ে চলছে। নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পটি ‘মানুষ মরার নিত্য ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে।
মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ইস্কাটন অংশে গত বছরের ১৬ মার্চ নির্মাণ কাজ চলার সময় লোহার ভারি খ- পড়ে ঘটনাস্থলেই মোহাম্মদ ইমন নামের এক শ্রমিক মারা যায়। এ ঘটনায় ২৭ মার্চ একজন আইনজীবী জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করলে উচ্চ আদালত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলাকালে দুর্ঘটনা এড়াতে সাধারণ জনগণ ও নির্মাণ শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী, ডেপুটি কমিশনার ঢাকা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এই নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু এরপরও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে। ফলে গত বছরের ১৬ জুন নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ওপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে সুমন (২২) নামে আরেক শ্রমিক মারা যান। চলতি বছরের ১৩ মার্চ সর্বশেষ নিহতের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন মোহাম্মদ স্বপন নামের আরেক শ্রমিক। মালিবাগ রেলগেটে গার্ডার চাপা পড়ে মারা গেছেন ওই শ্রমিক। তিনি পেশায় কাঠমিস্ত্রি। ওইদিন রাতে ফ্লাইওভারের কাজের নিরাপত্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দু’জন।
ঢাকাবাসীর নির্বিঘœ চলাচল নিশ্চিত করতে এ প্রকল্পটি একনেক অনুমোদন করে ২০১১ সালের ৮ মার্চ। চার লেনবিশিষ্ট দীর্ঘ ফ্লাইওভারের প্রথম নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৩৪৩ কোটি টাকা। এরপর নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সর্বশেষ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করে করা হয়েছে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। প্রথমে প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয় ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। যদিও প্রকল্পের কাজ শুরু হয় দেরিতে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি । সেই সময় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়। এরপর প্রথম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ করতে না পারায় পুনরায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা-মগবাজার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনের অংশ চালু হয়েছে গত বছরের ৩০ মার্চ। আর ইস্কাটন-মগবাজার ওয়্যারলেস পর্যন্ত অংশ চালু হয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে ফ্লাইওভারের মালিবাগ-মৌচাক এবং শান্তিনগর-রাজারবাগ অংশের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
কর্তব্যকাজে অবহেলার জন্য শাস্তির বিধান আমাদের প্রচলিত আইনেই রয়েছে। রাজধানীর শাহজাহানপুরে রেলের পরিত্যক্ত নলকূপে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় প্রকৌশলী ও ঠিকাদারসহ চার আসামীকে দশ বছরের কারাদণ্ড প্রদানের ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই মামলায় ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান আসামীদের উপস্থিতিতে তিন বছর আগের এই আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আসামীদের মধ্যে শাহজাহানপুর রেল কলোনিতে পানির পাম্প বসানোর প্রকল্প পরিচালক রেলওয়ের সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএসআর এর মালিক প্রকৌশলী আব্দুস সালাম, কমলাপুর রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার আবু জাফর আহমেদ শাকিরকে সাজার আদেশ দিয়েছেন বিচারক। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারার দ্বিতীয় অংশ অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজা দশ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই বছর বিনামশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেন আদালত।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এই আসামীদের অবহেলার কারণে একটি চার বছরের শিশুর অকাল মৃত্যু হয়েছে খেলতে গিয়ে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) দিপক কুমার ভৌমিক ও সাইফুল ইসলামকে খালাস দেন বিচারক।
২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর শাহজাহানপুর রেল কলোনিতে খোলা থাকা কয়েকশ ফুট গভীর এক নলকূপের পাইপে পড়ে যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। প্রায় ২৩ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস অভিযানে অনেক নিচে ক্যামেরা নামিয়েও ফায়ার সার্ভিস কোনো মানুষের ছবি না পাওয়ায় পাইপে জিহাদের অস্তিত্ব থাকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। ওই সন্দেহ রেখেই উদ্ধার অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েকজন তরুণের তৎপরতায় তৈরি করা যন্ত্রে পাইপের নিচ থেকে উঠে আসে অচেতন জিহাদ। হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, শিশুটি বেঁচে নেই।
জিহাদের মৃত্যুর ওই ঘটনা সে সময় সারা দেশে আলোড়ন তোলে। এর জন্য দায়ীদের শাস্তিরও দাবি ওঠে। এরপর জিহাদের বাবা অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগ এনে শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, রেল কলোনির একটি পানির পাম্পে লোহার পাইপ দিয়ে কূপ খনন করা হয়। কূপে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে মুখ খোলা অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিত্যক্তভাবে ফেলে রাখা হয়। ফলে বাদীর ছেলে জিহাদ কূপের পাশে খেলার সময় পড়ে মারা যায়। এরপর ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান।
শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত এই চার আসামীর কেউ সরাসরি জড়িত নয়। কিšুÍ এত গভীর একটি গর্ত খোলা অবস্থায় রেখে কর্তব্যকাজে অবহেলা করেছেন আসামীরা। কর্তব্যে অবহেলার কারণেই আদালত তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন। এই মামলাটি কর্তব্যকাজে অবহেলার শাস্তি সংক্রান্তে একটি দৃষ্টান্তমূলক রায়। পাইপের ঢাকনা খোলা রাখায় যদি ৪ জনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হতে পারে তবে মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণে যারা পুরো রাস্তাই অনিরাপদ করে মানুষের জীবনকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে তাদের শাস্তি হবে না কেন? যেখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং অপরাপর সংশ্লিষ্টদের চরম অবহেলার কারণে ইতোমধ্যে তিনজনের মৃত্যুও ঘটেছে।
# লেখক-সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

http://www.dailysangram.com/post/284799-