লালবাগের এই জায়গায় একসময় ছিল পুষ্প সাহা পুকুর। দখলে হারিয়ে গেছে সেটি। ছবিটি সম্প্রতি তোলা l প্রথম আলো
২১ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:১২

৫০ কাঠার পুকুর গায়েব!

পুরান ঢাকার লালবাগের জগন্নাথ সাহা রোডে গিয়ে স্থানীয় দুজন তরুণকে জিজ্ঞাসা করে পুষ্প সাহা পুকুরের সন্ধান মিলল না। পরে স্থানীয় কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ পুকুরের পথ বাতলে দিলেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী, জগন্নাথ সাহা রোড থেকে ৫ ফুট চওড়া ও ২০০ ফুট লম্বা একটি গলির মাথায় গেলে দেখা মেলার কথা পুকুরটির। কিন্তু গলির মাথায় গিয়ে পুকুরের দেখা মিলল না। পাওয়া গেল ময়লা-আবর্জনায় ভরা একটি খালি জায়গা। আশপাশে কিছু স্থাপনা। স্থানীয় ব্যক্তিরা নিশ্চিত করলেন, ওই জায়গাটিই পুষ্প সাহা পুকুর।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাগজে-কলমে পুকুরটির আয়তন উল্লেখ করা আছে প্রায় ৫০ কাঠা। কিন্তু বাস্তবে পুকুরের অস্তিত্ব নেই। পুকুরের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ঘর ও বহুতল স্থাপনা। তবে পুষ্প সাহা পুকুর দখলমুক্ত করতে ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), গ্রিনমাইন্ড সোসাইটি, পুষ্প সাহা পুকুর রক্ষা কমিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পুকুরটি দখলমুক্ত করতে একাধিকবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লিখিত আবেদন করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এর সুযোগ নেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১২ সালের এপ্রিলে অর্পিত সম্পত্তির ‘ক’ তফসিলের গেজেট প্রকাশ করা হয়। তফসিলে পুকুরটির মালিক হিসেবে ঢাকা জেলা প্রশাসনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০১০ সালে পুরো পুকুরটির মালিকানা দাবি করে উচ্চ আদালতে মামলা করেন নাজিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। এই মামলা এখনো চলছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, পুকুরের উত্তর ও পশ্চিম পাড়ে বড় দুটি পাকা ঘাট ছিল। শহীদনগর, চৌধুরী বাজার, নবাবগঞ্জ ও বালুঘাট এলাকার মানুষ গোসল ও গৃহস্থালির কাজে এই পুকুর ব্যবহার করত।
সরেজমিনে দেখা যায়, পুষ্প সাহা পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে রিকশার গ্যারেজ ও তিনটি বড় টিনের ঘর। এর মধ্যে তালাবদ্ধ একটি ঘরের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ‘জাতীয় শ্রমিক লীগ, লালবাগ থানার প্রধান কার্যালয়’। এর পাশে আনন্দ স্কুল। এর উত্তর পাশে লম্বা আরেকটি তালাবদ্ধ ঘর। উত্তর-পূর্ব কোণে দুটি প্লাস্টিক ও স্টিলের কারখানা। কথা বলার জন্য এসব কারখানার মালিকদের পাওয়া যায়নি। বাকি জায়গায় ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে। আশপাশের বাসাবাড়ির বর্জ্য, পুরোনো ভবনের ভাঙা কংক্রিট পুকুরের জায়গায় ফেলা হচ্ছে। পুকুরের উত্তর পাড়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পুরোনো একটি রাজবাড়ী।
ডিএসসিসির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পুকুরটি দখলমুক্ত করতে তিনবার জেলা প্রশাসকের বরাবর লিখিত আবেদন করেছি। কিন্তু তাঁরা কোনো সাড়া দিচ্ছেন না।’ তিনি বলেন, পুকুরটির চারপাশে যে যাঁর মতো ভরাট করে তা দখল করছেন। পাঁচ থেকে সাত বছর আগে পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে চারটি বহুতল ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন করে দখলে মেতেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
জেলা প্রশাসন সূত্র ও স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ২০০৫ সালের পর স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ৫০ কাঠার পুকুরটির চারপাশে ইট-পাথর ও আবর্জনা ফেলে ভরাট শুরু করেন। এর মধ্যে মামলা দায়েরকারী নাজিম উদ্দিনও রয়েছেন। তিনি পুকুরের দক্ষিণ পাশ ভরাট করে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেন। এর পাশে পুকুরের প্রায় ২০ শতাংশ জায়গাও তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাজিম উদ্দিনের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে পুষ্প সাহা পুকুর রক্ষা কমিটির সভাপতি সায়েমুল ইসলাম বলেন, শত বছরের পুরোনো এই পুকুরের মালিক ছিলেন জগন্নাথ সাহা ও তাঁর পরিবার। তাঁর পরিবারের এক সদস্যের নামে এর নামকরণ করা হয়। পুকুরের উত্তর পাড়ের বাড়িটিও তাঁদের ছিল। বাড়িটি জেলা প্রশাসনের অধীনে রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের অবহেলায় পুকুরটির এই অবস্থা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পুকুরটি দখলমুক্ত করতে অনেক আন্দোলন করেছি। জেলা প্রশাসনে একাধিকবার আবেদনও করেছি। কিন্তু তারা কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা শহরের ঐতিহ্য বলতে আর কিছুই থাকবে না।’
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের অর্পিত সম্পত্তি শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইলিয়াস মেহেদি বলেন, পুকুরের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। কাগজপত্র দেখে এর অবস্থান জানাতে পারবেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1187296/