২১ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:০৬

ভূমিমন্ত্রীর পরিবারের কবজায় ঈশ্বরদী

ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর পরিবারের দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ মানুষ। বিভিন্ন ঘটনায় আলোচিত-সমালোচিত পরিবারটির সদস্যের কবজায় পুরো ঈশ্বরদী এলাকা। তৃণমূলের রাজনীতিও তাদের হাতেই জিম্মি। কোথায় নেই তারা! ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ- সবখানেই তাদের একচেটিয়া রাজত্ব। আগে মন্ত্রী পরিবারের হয়ে এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখেন ডিলুর জামাতা ও পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু। গৃহবিবাদে ক্ষমতার পালাবদলও হয়। ঈশ্বরদী এসে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন মন্ত্রীর ছেলে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিরহান শরীফ তমাল। তবে আগের মতোই চালকের আসনে থাকেন ডিলুর স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুন্নাহার শরীফ। জামাই-শ্বশুর দ্বন্দ্বেই মূলত ঈশ্বরদী অশান্ত হয়ে পড়ে; ঘটতে থাকে একের পর সহিংসতা।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার তমাল ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজীব সরকারের নেতৃত্বে মিন্টুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। একই সময়ে উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাসের বাড়িতেও তাণ্ডব চালায় সশস্ত্র হামলাকারীরা। রাতে মামলার পরই তমালসহ যুবলীগ-ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকেই স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ আরও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। পুলিশ-প্রশাসনেও বদলির গুঞ্জন শুরু হয়। গতকাল শনিবার দিনভর উপজেলার সর্বত্র থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে। স্থানীয়রা জানান, আবারও সংঘাতের শঙ্কায় তারা আতঙ্কিত।


এসব বিষয়ে কথা বলতে শুক্রবার ভূমিমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে 'তিনি অসুস্থ, কথা বলতে পারবেন না' বলে জানান ছেলে তাকিবুর রহমান শরীফ। গতকাল আবার চেষ্টা করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তবে কামরুন্নাহার শরীফ হামলা ও এ ঘটনায় তমালকে অভিযুক্ত করায় জামাতা মিন্টুকে দায়ী করেন। তিনি সমকালকে বলেন, পরিবারের পক্ষে স্থানীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে তমালকে এখানে আনা হয়। এমবিএ পাস করা ছেলেকে সন্ত্রাস ও ভাংচুরের মামলায় আসামি করা হয়েছে। সোনার ছেলেটাকে যারা জেলে পাঠিয়েছে, তাদের মিথ্যাচারের ক্ষমা নেই। তিনি আরও বলেন, বারবার কাউকে ক্ষমা করা যায় না। দুধ-কলা দিয়ে পোষা কাল সাপ আজ আমাকেই দংশন করেছে। মিন্টুর নাম উল্লেখ করে কামরুন্নাহার বলেন, পায়ে ধরে মাফ চেয়ে সে পৌর মেয়রের মনোনয়ন ও নৌকা প্রতীক পায়। কিন্তু তার নৈরাজ্য ও বাড়াবাড়ি সীমা লঙ্ঘন করেছে। এবার সে ও তার সহযোগীদের রেহাই নেই। এর শেষ দেখে ছাড়ব। ঈশ্বরদীর মানুষ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।


বৃহস্পতিবারের তাণ্ডবকে জঙ্গি হামলার সঙ্গে তুলনা করে মিন্টু বলেন, দিনের বেলায় মুখে কালো কাপড় ও মাথায় ফিতা বেঁধে হামলা-ভাংচুর চালিয়ে যারা নিজেদের সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের দিয়ে সুষ্ঠু রাজনীতি সম্ভব নয়। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায়, সেজন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। শাশুড়ির অভিযোগ ও আগামী দিনে ঈশ্বরদীর রাজনীতি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, কে নেতৃত্ব দেবেন তা দলীয় প্রধানই ঠিক করবেন। কারা দক্ষ সংগঠক, ত্যাগী, দলের জন্য নিবেদিত তার সব রেকর্ড হাইকমান্ডের কাছে রয়েছে। কাজেই এখানে পরিবারতন্ত্রের সুযোগ নেই। মিন্টু বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করছি। আমার নিজস্ব পরিচয় আছে; মন্ত্রীর জামাতা হিসেবে পরিচিত হতে চাই না।


ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মন্ত্রী পরিবারের আরও দখলদারিত্বের তথ্য মিলেছে। জানা যায়, ঈশ্বরদী পৌরসভার প্রথম প্রশাসক প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম ফকিরের পরিবারের প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৪০ বিঘা জমি ডিলুর পরিবারের কবজায় রয়েছে। বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও তা দখল করা হয়েছে। দীর্ঘ ১৫-১৬ বছরেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সভাপতি আকবর আলী বিশ্বাসের বাড়ির জায়গাও দখলে নিয়েছে মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন। আকবর আলী বিশ্বাস আক্ষেপ করে বলেন, বিভিন্ন জনের কাছে গিয়েছি, বিচার পাইনি। তাই আর কাউকে কিছু বলতে চাই না।


এ ছাড়া পূর্বটেংরিতে অবস্থিত ৪১ শতাংশ জমিসহ একটি অর্পিত সম্পত্তি কয়েক হাত ঘোরার পর সাফকবলা দলিল করে নিয়েছেন কামরুন্নাহার। ৪৪টি দোকানসহ একটি মার্কেটও মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন দখল করে নিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কামরুন্নাহার শরীফ। তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক পরিবার; ঈশ্বরদীবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তমালকে রাজনীতিতে আনা হয়েছে। তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করতেই মিন্টু ও তার সহযোগীরা এসব মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছে।


পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি: পাবনা-৪ (আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী) আসনের সাংসদ শামসুর রহমান শরীফ ডিলু বর্তমানে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার নির্দেশ মতোই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি থেকে শুরু করে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন মন্ত্রীর খালাতো ভাই ও সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) বশির আহমেদ বকুল। গত বছরের ১৯ নভেম্বর বাবার বদৌলতে উপজেলা যুবলীগের সভাপতির পদ পান তমাল। একই সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক করা হয় তাদের অনুগত রাজীব সরকারকে। উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন ভূমিমন্ত্রীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ। সূত্র মতে, তিনিই নেপথ্যে থেকে ঈশ্বরদীতে তাদের পরিবারের আধিপত্য বজায় রেখেছেন। মেয়ে মাহজাবিন শিরিন পিয়াও স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সমর্থন না পেলেও তিনি বাবার প্রভাব খাটিয়ে প্রার্থী হন। তবে নির্বাচনে তার ভরাডুবি হয়।


জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভূমিমন্ত্রীর পরিবার সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জেলা কমিটির সভাপতিকে না জানিয়ে উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের সম্মেলন করার উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রীর ছেলে আনিসুর রহমান শরীফকে পদ দিতে তা করা হয়েছিল। তবে পরে সম্মেলন হয়নি।


কিছুদিন আগেও পরিবারটির হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতেন মিন্টু। তিনি মাহজাবিন শিরিন পিয়ার স্বামী। মিন্টুর সঙ্গে আছেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম খান ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাস। তবে জামাই-শ্বশুর দ্বন্দ্বে তারা এখন মন্ত্রী পরিবারের প্রতিপক্ষ।


ক্ষমতার কেন্দ্রে কামরুন্নাহার: ভূমিমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ঈশ্বরদীর রাজনীতি ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন কামরুন্নাহার শরীফ। মন্ত্রী ঈশ্বরদীতে অবস্থান না করলে দলের প্রায় সব অনুষ্ঠানে তাকেই প্রধান অতিথি করা হয়। আবার স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কিংবা অন্য যে কোনো অনুষ্ঠানে মন্ত্রীপত্নীকে প্রধান অতিথি করা একপ্রকার 'বাধ্যতামূলক'। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তা না মানলে মন্ত্রীর বাড়িতে ডেকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয় বলেও একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে এ বিষয়ে কামরুন্নাহার শরীফ বলেন, ঈশ্বরদীর মানুষ চায় বলেই মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে আমি সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিই।


আরও দুই মামলা: বৃহস্পতিবারের হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় গতকাল তমালকে বাদ দিয়ে ৩৪ জনকে আসামি করে ঈশ্বরদী থানায় আরও দুটি মামলা হয়েছে। বাদী হয়েছেন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধা আজমল হক বিশ্বাস ও ফুড জংশনের মালিক শরিফুল ইসলাম রুয়েন। রুয়েন ফোনে জানান, মামলার পর থেকে তিনি নানা ধরনের হুমকি-ধমকি পাচ্ছেন। তাই আত্মগোপনে আছেন।


ঈশ্বরদী থানার ওসি আবদুল হাই তালুকদার বলেন, আমি খুব চাপে আছি। তবে মামলার অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।


এদিকে ওসি আবদুল হাই তালুকদারকে বদলি করা হয়েছে বলে গতকাল উপজেলায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাকে বদলি করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেন জেলা পুলিশ সুপার জিহাদুল কবীর পিপিএম। ঈশ্বরদীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দিনভর শহরে ছিল পুলিশি টহল। শহরে গতকাল ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি।

http://bangla.samakal.net/2017/05/21/294368