২০ মে ২০১৭, শনিবার, ১০:১৪

নতুন ভ্যাট আইনে আটকে যাচ্ছেন ছোট ব্যবসায়ীরা

নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে চলছে কাউন্ট ডাউন। আর বাকি মাত্র ৪০ দিন। এ নিয়ে চলছে পক্ষে বিপক্ষে প্রচারণা। ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের ভেটো অব্যাহত রয়েছে। ভ্যাটের হার কমিয়ে ১৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হলেও বার্ষিক টার্নওভার সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। এতে করে ভ্যাটের জালে আটকে যাচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীরা। বন্ধ হয়ে যাবে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা বলছেন আয়কর, করপোরেট কর, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শুল্কসহ নানা প্রস্তাবনা উপেক্ষা করেই চলছে বাজেট প্রস্তুতির কাজ। এতে করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের শেষ ভরসাস্থল হলেন প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, নতুন ভ্যাট আইনে বার্ষিক টার্নওভার ধরা হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। যদি কোন ব্যবসায়ী বছরে ৩০ লাখ টাকা বিক্রি করে থাকেন তাহলে তাকে অবশ্যই ভ্যাট দিতে হবে। এ হিসেবে দেখা গেছে, প্রতি মাসে একজন ব্যবসায়ীকে বিক্রি করতে হবে মাত্র আড়াই লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি দিন বিক্রি করতে হবে ৮ হাজার ৩৩৪ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীতে এমন কোন ফুটপাত কিংবা মুদির দোকান নেই যিনি প্রতিদিন এ পরিমাণ বিক্রি করেন না। তাহলে নতুন এই আইনে সবাই কর জালের মধ্যে রয়েছে। এনবিআরের লোকবল কম রয়েছে বলে শুরুর দিকে হয়তো সব প্রতিষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হবে না কিন্তু তারা চাইলেই যে কোন দোকানদারকে ভ্যাটের আওতায় আনতে পারেন।
অথচ এনবিআর বলছেন, ব্যবসায়ীরা ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট নিয়ে থাকেন কিন্তু তারা সে ভ্যাট জমা না দিয়ে ফাঁকি দিয়ে থাকেন। যারা ফাঁকিবাজ তারাই শুধু বিরোধিতা করছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা ভ্যাট নিয়ে জমা দেন না এনবিআরের এমন বক্তব্য সত্য। তাহলে ভ্যাট ফাঁকি ঠেকাতে কি সরকার এই আইন করছেন। নাকি সবাইকে ভ্যাটের আওতায় আনতে এই আইন করা হয়েছে। তা এখনও স্পষ্ট নয়। যদি ভ্যাট ফাঁকিরোধে এই আইন করা হয়ে থাকে তাহলে এনবিআরের কর্মকর্তারা কি করে থাকেন। তারা নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীর মনিটরিং করতে পারছে না। তাহলে এত ব্যবসায়ীদের তারা কিভাবে মনিটরিং করবে।
তবে এনবিআর বলছে, তারা বড় সব দোকানেই ইসিআর মেশিন দেবেন। বছর শেষে তারা হিসাব নেবেন। যদি দেখেন টার্নওভার ৩০ লাখের উপরে হয়ে থাকে তাহলেই ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করতে হবে। কিন্তু এর নীচে হলে তাকে ভ্যাট দিতে হবে না। আর যদি ৮০ লাখ টাকার উপর টার্নওভার হয়ে থাকে তাহলে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হবে।
মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আইন ২০১২ বাস্তবায়ন হবে চলতি বছরের পহেলা জুলাই থেকে। এটি ২০১৬ সালের জুলাই থেকে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতার কারণে সম্ভব হয়নি। এমনকি যারা ভ্যাট আইন প্রয়োগ করবেন তাদেরও এই আইনের অস্পষ্টতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। জটিলতা ও অস্পষ্টতা দূরীকরণের লক্ষ্যে কমিটি গঠন কিংবা নানা বৈঠক হলেও কার্যত ফলপ্রসূ কিছুই হয়নি। ব্যবসায়ীদের দু’একটি সংগঠন বাদে অন্যরা ঢালাও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের বিপক্ষে।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যাট সহনীয় করা হবে। ইতোমধ্যে ১৩ শতাংশ ভ্যাট করার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয়েছে। তিনি তা নাকচ করে দিয়েছেন। ব্যবসাযীরা বলছেন ভ্যাট ১২ শতাংশ হতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ্যাটের হার নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি আপত্তি রয়েছে বার্ষিক টার্নওভার নিয়ে। বার্ষিক টার্নওভার ৮০ লাখ টাকা করা হলেই ব্যবসায়ীদের কোন অভিযোগ থাকবে না। কিন্তু এনবিআর ভ্যাট হার কমাতে রাজি হলেও টার্নওভার বাড়াতে রাজি নয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশীয় অনেক পণ্যের উপর ভ্যাট নেই। কিন্তু এখনও বিক্রীত সব পণ্যের উপরই বিক্রেতারা ভ্যাট দিতে হবে। তাহলে দেশীয় পণ্য কিভাবে ভ্যাট রেয়াতি সুবিধা পাবে। দেশীয় পণ্য যদি কর রেয়াতি সুবিধা না পায় তাহলে বিদেশী পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় কোনভাবেই টিকে থাকতে পারবে না। এতে করে সংকটে পড়তে পারে দেশীয় উদ্যোক্তারা। নতুন করে আর কোন উদ্যোক্তা বিনিয়োগে সাহস পাবে না। এতে করে বিনিয়োগ আরও স্থবির হয়ে পড়বে।
তবে ভ্যাটের ইতিবাচক দিক তুলে ধরে ইতোমধ্যেই নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর)। তাদের এ প্রচারে যুক্ত করা হয়েছে সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতাকে। তারা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন অনেক ভালো। এতে হয়রানি অনেক কমবে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা বুঝেই এই আইনের বিরোধিতা করছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্ব আয় কতটা বাড়বে, সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোক্তাপর্যায়ে এর কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে কোনো সমীক্ষা অর্থ মন্ত্রণালয় বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করেনি। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও এ ধরনের কোনো গবেষণা নেই। তবে দুই পক্ষই নিশ্চিত যে নতুন আইন প্রয়োগ করা হলে ভ্যাট আদায় বাড়বে, ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। তবে এই চাপ সামগ্রিক অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই কোনো পক্ষেরই।
তবে ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের ভেটো আব্যাহত রয়েছে। তারা চেয়ে আছে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের দিকে। তারা আন্দোলন করেছেন এবং এনবিআরে নানা প্রস্তাবনাও দিয়েছেন। এছাড়া আর কিছুই তাদের করার নেই।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সদ্যবিদায়ী সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, বর্তমান ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছি আমরা। তবে আমরা এখনও জানতে পারিনি যে হার কমিয়ে কত শতাংশ করা হবে। আমরা বলেছিলাম আমাদের আগে জানানোর জন্য তাহলে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারতাম। কিন্তু জুলাইয়ের আগে তা জানানো হবে না বলে বলা হয়েছে আমাদের।
ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ করা হলে তাতে আপনাদের আপত্তি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপত্তির বিষয় না। সরকার যদি করে আমরা সেভাবেই ভ্যাট দেব। কিন্তু ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব করেছি ৭ শতাংশ করার। নতুন আইনে তা না করা হলে আমরা আমাদের চাওয়া চেয়ে যেতে থাকব। আর আশা করছি সরকার আমাদের আশা পূরণ করবে এবং আমি আরো আশা করছি হয়রানি সমস্যা দূর করতে পারবে নতুন ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প। কারণ এখনো ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। এটি চালু হলে হয়রানি কমে যাবে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সম্পূর্ণরূপে অনলাইন ভ্যাটের আওয়ায় আসতে তিন বছর সময় লাগবে।
ভ্যাট আদায়ের হার নিয়ে শুরু থেকেই তীব্র বিরোধিতা করছেন এফবিসিসিআইয়ের সদ্যনির্বাচিত সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, ঢালাওভাবে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট আইনের আওতায় নিলে সরকারের জন্য এটা হবে বড় ধরনের ভুল। তার মতে, ব্যবসায়ীদের মতামতের বাইরে গিয়ে ভ্যাট আদায় হলে তা হবে সোনার ডিম পাবার আশায় হাঁসকেই জবাই করার শামিল। কারণ ভ্যাটই ব্যবসায়ীদের বর্তমানের বড় সমস্যা।
নতুন আইনে ব্যবসায়ীদের আশা পূরণ না হলে সামনে সমস্যা আরো বাড়বে। যারা ব্যবসায়ীদের ওপর এ আইন চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন, তারা ভালো করেননি। এর সঙ্গে আইএমএফ থাকুক আর যেই থাকুক, আশানুরূপভাবে আইন পাস হলেও তা বাস্তবায়ন হতে পারবে না।
শফিউল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ীরা কোনো প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না, একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে চায়। আর ব্যবসায়ীরা সরকার থেকে আলাদা নয়। রাজনীতিবিদ, আমলা, সরকার এবং ব্যবসায়ী- এরা কেউ আলাদা নয়। সবাই একসঙ্গে এগিয়ে যেতে চায়।
এছাড়া ভ্যাট আইনের আরেকটি বিষয় নিয়ে দেশের শিল্প মালিকদের উদ্বেগ রয়েছে। বিদ্যমান আইনে দেশের এক হাজার ৫২০টি পণ্যকে সুরক্ষা দেয়া আছে। অর্থাৎ, এই এক হাজার ৫২০টি পণ্য বিদেশ থেকে কেউ আমদানি করলে তাকে সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এতে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ে আর ওই শ্রেণির দেশী পণ্য সুরক্ষা পায়। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইনে এক হাজার ৫২০টি পণ্যের মধ্যে এক হাজার ৩৫০টির ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। তখন আমদানি করা পণ্যের দাম কমবে। একই পণ্য দেশে যারা উৎপাদন করেন, তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়বেন। বাজেট সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর নানা দাবি ও প্রস্তাব দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, সমিতি ও চেম্বার থেকে এসব প্রস্তাব লিখিতভাবে দেয়া হয়। এনবিআর থেকেও প্রতিবছর বাজেটের আগে কয়েক মাস ধরে চাওয়া হয় লিখিত প্রস্তাব। আয়কর, করপোরেট কর, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শুল্কসহ নানা বিষয়ে দেয়া এসব প্রস্তাবের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয় না বাজেটে।
অবশ্য এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান মনে করেন, বিভিন্ন সংগঠনের দেয়া লিখিত সুপারিশগুলোকে বাজেট প্রস্তাবে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা করা হয়েছে। ওইসব আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান সব সময়ই বলে আসছেন, লিখিত প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

 

http://www.dailysangram.com/post/284558-