অন্যকে আটকে আগে যাওয়ার এই প্রবণতা সড়কে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। লেন না মানা, আড়াআড়ি বাস রেখে অন্য যানবাহনের চলাচলে অসুবিধা করা—এসব লেগে থাকে সড়কে। দেখার যেন কেউ নেই! ছবিটি সম্প্রতি ফার্মগেট এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো
২০ মে ২০১৭, শনিবার, ৯:৫৫

ঢাকায় ২৮,৫৪৯টি নিবন্ধিত বাস

বাস বাড়ছে, ভোগান্তি কমছে না

বুধবার রাত সোয়া ১০টা। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে সারিবদ্ধ কয়েকটি ৬ নম্বর বাস। সবচেয়ে সামনেরটা মোড়ে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনেরটা পাশ দিয়ে মাথা বের করে সেটিকে সমানে গুঁতিয়ে চলেছে। শুধু এই বাস দুটির জন্য পেছনে যানবাহনের সারি প্রায় আধা কিলোমিটার লম্বা হয়ে গেছে। রাজধানীতে এমন দৃশ্য প্রতিদিনের। ব্যস্ত সময়ে সমস্যাটা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
ঢাকায় গত দুই বছরে বাস বেড়েছে হু হু করে। কিন্তু যাত্রীসেবা বাড়েনি, যানজটও কমেনি। নিত্যভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। বাসের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলকে যানজটের অন্যতম কারণ বলে দায়ী করছে পুলিশও। বাসমালিকেরা বলছেন, চালকদের গুঁতোগুঁতি আর হুড়োহুড়িতে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা। তাহলে কি চালকেরাই ঢাকার রাস্তার সব বিভীষিকার জন্য দায়ী?
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সবই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ব্যর্থতা। বিআরটিএর হিসাবে ঢাকা শহরে ৩২০টি পথে ১৫৯টি কোম্পানির বাস ও মিনিবাস চলছে। এগুলোকে মোটা দাগে কয়েকটি কোম্পানি (ফ্র্যাঞ্চাইজ কোম্পানি) করে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত মোট বাসের সংখ্যা ২৮ হাজার ৫৪৯টি। এর মধ্যে ২০১০ সালের পরের ছয় বছরে নিবন্ধিত হয়েছে পৌনে ১২ হাজার বাস। বিগত বছরগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে নিবন্ধিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাস। ২০১৫ সালে সোয়া ২ হাজার, ২০১৪ সালে সোয়া হাজার এবং ২০১৩ সালে ৯৭১টি বাস নিবন্ধিত হয়। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ১ হাজার ১২টি বাস নিবন্ধিত হয়েছে। বর্তমান প্রবণতায় চলতি বছরের শেষ নাগাদ অন্তত ৪ হাজার বাস নিবন্ধন হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
রাস্তাঘাটের গা সওয়া দৃশ্য
যেখানে-সেখানে ইচ্ছেমতো বাস থামিয়ে রাখা, অন্য বাসকে টেক্কা দিতে আড়াআড়ি করে বাস রেখে পুরো রাস্তা আটকে রাখার দৃশ্য নিত্যদিনের। বাসচালকেরা বলছেন, ‘এটাই নিয়ম’। ফলে রাস্তায় যেমন খুশি তেমনভাবে চলছে বাসগুলো।
রোববার দুপুর ১২টার দিকে সকালে গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ীগামী একটি বাসে উঠে কথা হচ্ছিল চালক জামশেদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, সামনের গাড়ি যদি জায়গা না ছাড়ে তাহলে পেছনের গাড়ি যাত্রী তুলবে কীভাবে। শুধু হর্ন দিলেই কাজ হয় না, পেছন থেকে গাড়ি দিয়ে গুঁতো দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘কখনো গুঁতাতেও কাজ হয় না, হেলপাররে গিয়া ঝগড়াঝাঁটি কইরা আসতে হয়।’
জামশেদের বাসটি কল্যাণপুরে এসে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় হেলপার ইমরান চিৎকার করে ওঠে ‘ওস্তাদ লম্বর’ (অর্থাৎ পেছনে একই রুটের আরেকটি বাস আসছে)। সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠেন জামশেদ। বাসটিকে ওভারব্রিজের নিচে আড়াআড়ি করে রেখে দেন কিছুক্ষণ। হেলপারের যাত্রী ডাকাডাকির মাত্রাও বেড়ে যায়। একই কাজ তিনি করলেন শ্যামলীতে গিয়েও। শ্যামলীতে পেছন থেকে আরেক বাসের ‘গুঁতা’ও খেলেন।
কেন এ রকম করেন জানতে চাইলে জামশেদ বলেন, ‘এরম না করলে যাত্রীরা ওঠে না। হ্যারাও (যাত্রীরা) তাকায় তাকায় দ্যাহে কোনডা আগে যাইব।’
মধ্য দুপুরের গরমের সঙ্গে বাসের ইঞ্জিনের গরম যোগ হয়ে ভেতরে অসহনীয় অবস্থা। এর মধ্যে চালকের ঢিলেমি আচরণে খেপে
যান একজন যাত্রী। কিছুই গায়ে মাখেন না জামশেদ। উল্টো তিনি বলেন, ‘কয় ট্যাকা আর ভাড়া দিছে! ভাবটা দ্যাখছেন, মনে হয় কিন্না নিছে।’
গাবতলী-যাত্রাবাড়ী পথের অন্য বাসগুলোর মতো জামশেদের বাসটির সামনে-পেছনে দোমড়ানো। অন্য বাসের সঙ্গে ঘষা খেয়ে দুই পাশের লোহার বডিতে ঢেউ তোলা, কয়েকটি জানালায় কাচ নেই। জামশেদ দাবি করেন, বাসটি পুরোনো হলেও বছরখানেক আগে নতুন বডি বানানো হয়েছে। কিন্তু বাস দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
বাসমালিকেরাও অসহায়!
বাসমালিকেরা বলছেন, চালকদের এ রকম গুঁতোগুঁতিতে তাঁরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চালকদের শত অনুরোধ বা কাউন্সিলিং করেও ফল পাচ্ছেন না।
পল্লবী সুপার সার্ভিসের পরিচালক (অর্থ) ও দোয়েল পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজ মিনা প্রথম আলোকে বলেন, চালকদের এই গুঁতোগুঁতি হুড়োহুড়ির কারণে বাসের লুকিং গ্লাস (আয়না) ভাঙা এখন খুব সাধারণ ঘটনা। জানালার কাচও প্রায় ভাঙে। একেকটা কাচের দাম এক হাজার থেকে বারো শ টাকা। কিন্তু কাউকে কিছুই বলার নেই। দেখা যায় বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বা ক্ষতি করে চালক-হেলপার বাস ছেড়ে পালায় বা পরদিন আর কাজেই আসে না। এসব ক্ষতির জন্য একদিন তাদের শাস্তি দিলে পরদিন অন্য মালিকের কাছে চলে যায়। তারা সব রকম দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে। বাসমালিকেরা তাদের কাছে একরকম জিম্মি।
অগ্রদূত পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রাইদা পরিবহনের পরিচালক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, একটা নতুন গাড়ি নামানোর পরে সর্বোচ্চ ছয় মাস রংটা থাকে। এরপর এমন অবস্থা হয়! কোম্পানির পক্ষ থেকে বারবার চালকদের বলা হয়, কাউন্সিলিংও করা হচ্ছে এখন। কিন্তু রাস্তায় নামলে তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো গাড়ি আসছে ঘষা খেয়ে, কাচ ভেঙে। চালকদের শাস্তি দেওয়া হয়, জরিমানা করা হয়, বেতন আটকে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না। সোহেল রানা বলেন, একেকটা গাড়ি খুব সাধারণভাবে রং করতেই ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লেগে যায়। প্রতি মাসে তো আর এটা করা যায় না। তাই বছর না ঘুরতেই গাড়িগুলো দেখতে একেবারে লক্কড়ঝক্কড় হয়ে যায়।
চেষ্টা করার কথা জানাল পুলিশ
এ দুটো ঘটনাকে যানজটের অন্যতম কারণ বলে দায়ী করলেও এগুলো থামাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না পুলিশও। পুলিশের চারজন সার্জেন্টের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তাঁরা বলেন, সকালবেলা ও সন্ধ্যায় বাসগুলোতে যাত্রী পূর্ণ থাকায় চালকেরা গন্তব্যে যাত্রীদের নামিয়ে ফিরতি ট্রিপ ধরতে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালান। তখন একরকম হুড়োহুড়ি। আর দুপুর ও রাতের খালি সময়ে এরা স্টপেজগুলোতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে। তখন এদের মধ্যে আরেক রকম প্রতিযোগিতা, গুঁতোগুঁতি। এদের কারণে কখনো কখনো ফাঁকা সড়কে যানজট লেগে যায়। স্টপেজগুলোতে কখনো পুলিশ সদস্যরা গিয়ে সরিয়ে দেন, মামলাও দেওয়া হয়। তারপরও ঠিক হয় না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মোসলেহউদ্দীন আহমেদ বলেন, বাসগুলোর এই অসুস্থ চর্চার বিরুদ্ধে কঠোর হতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এ জন্য পুলিশ প্রায়ই মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করে আসছে। প্রতিদিন প্রচুর মামলা হচ্ছে। এ ছাড়া শহরে বাস দাঁড়ানোর জন্য বাস বে বা স্টপেজ নেই। এগুলো তৈরি করা যায় কি না, সে বিষয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। তিনি বলেন, গণপরিবহনকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার একটা পথ হতে পারে ফ্র্যাঞ্চাইজ কোম্পানিকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া।
সমস্যার গোড়ায় সমাধান করতে হবে
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন এসব কোনো সমস্যা নয়, এগুলো হলো সমস্যার উপসর্গ। তিনি বলেন, ঢালাওভাবে রুট পারমিট দেওয়ার কারণে এই সমস্যার শুরু হয়। বাসচালককে শাস্তি দিয়ে, পুলিশকে দোষারোপ করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। শক্তি প্রয়োগ করে সাময়িক একটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। শুধু উপসর্গ দেখে ধারণা থেকে এর সমাধান বের করার চিন্তা ঠিক নয়। এর জন্য গোড়া থেকে পরিকল্পনার গলদটা শোধরাতে হবে। বাস পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানকে (কোম্পানি) দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট পথের সব বাস পরিচালনার দায়িত্ব একটি কোম্পানিকে (ফ্র্যাঞ্চাইজ কোম্পানি) দিতে হবে, যাতে বাস পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুলের জন্য কোম্পানিকে দায়ী করা যায়। সারা পৃথিবীতে এভাবেই বাস কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর জন্য আমাদের রাজনীতিকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1186351/