২০ মে ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৭

সোনা আমদানিতে নজর নেই কারো

বাজার চলছে চোরাকারবারিতে

দৈনিক ১০ কোটি টাকার সোনার বাজার রয়েছে দেশে। অথচ গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে এলসি খুলে এক তোলা সোনাও আমদানি করা হয়নি। সোনা ব্যবসার ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) নিবন্ধন নম্বর থাকলেই বৈধভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে মোট মূল্যের ৪ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে দেশে সোনা আমদানি করার বিধান রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চোরাই পথে আনা সোনায় নির্ভর করে চলছে দেশের সোনা ব্যবসা। স্থানীয় বাজারের চাহিদার কিছু অংশ পূরণ করছে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা সোনা। সোনার মতো সম্ভাবনাময় খাতে রমরমা ব্যবসা হলেও সরকারি কোষাগারে রাজস্ব হিসেবে জমা পড়ছে নামমাত্র কিছু। শুল্কনীতি বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ ও নজরদারির অভাবে আইনি পথে না হয়ে চোরাই পথে পরিচালিত হচ্ছে সোনা ব্যবসা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট সোনার সামগ্রী তৈরিতে প্রায় ৪০ শতাংশ পুরনো সোনা ব্যবহার করা হয়। বাকি ৬০ শতাংশ তৈরি হয় নতুন সোনায়। এনবিআরের হিসাবে, ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে হিসাব মতো রাজস্ব পরিশোধ করে বৈধভাবে সোনা আমদানি করে ব্যবসা করলে সরকারি কোষাগারে বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা জমা হওয়ার কথা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গত পাঁচ বছরে ব্যাংকের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে এক তোলা সোনাও আমদানি হয়নি। সোনা আমদানির অনুমতি চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি মাত্র আবেদনপত্র জমা আছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘যা কিছু রাজস্ব আদায় হয়েছে ব্যাগেজে আনা সোনায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্যাগেজে আনা সোনায় ভরিপ্রতি ১৫০ টাকা দিয়ে ৩১৫ কেজি সোনা দেশে আসে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় পাঁচ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর পরের ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যাগেজে আনা সোনায় শুল্ক বাড়িয়ে প্রতি ভরি তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই বছর ৪১১ কেজি সোনা ব্যাগেজে দেশে আনায় সরকারের রাজস্ব খাতে আয় হয় সাড়ে ১২ কোটি টাকা। ’
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর লক্ষ্য থাকে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা করা। ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে সোনা আমদানি অনেক বিনিয়োগের বিষয়। তার চেয়ে কম বিনিয়োগে ব্যাগেজে সোনা আনা সম্ভব। আবার ব্যাগেজে আনা সোনার চেয়ে কম বিনিয়োগ করতে হয় চোরাই সোনা সংগ্রহে। তাই যা সহজ এবং মুনাফার সে দিকেই ঝোঁক বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর।
এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ পাঁচ বছর বা সাত বছর বিদেশে বসবাস করলেই কেবল ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আনার অনুমোদন দেওয়া উচিত। একই পাসপোর্টে বছরে তিনবারের বেশি সোনা ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনার অনুমোদন দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া সোনা ব্যবসায়ীদের ব্যাংকে এলসি খুলে সোনা আনতে বিশেষ রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা ঘোষণা করতে হবে। তাহলে বৈধ পথে সোনা আমদানি বাড়বে। ’
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সভাপতি এবং ভেনাস জুয়েলার্সের মালিক গঙ্গা চরন মালাকার একই মত জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা দিলে অবৈধভাবে সোনা আমদানি বন্ধ হবে। এ ছাড়া চোরাই সোনা নিয়মমতো নিলামে তুলে আমাদের মাঝে সরবরাহ করা হোক। আমি আশা করি, এতে অবৈধ সোনার ব্যবসা বন্ধ হবে। ’
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ফেরার সময় একজন বিমানযাত্রী লাগেজে করে বৈধভাবে সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালংকার বিনা শুল্কে দেশে আনার সুবিধা পেতেন। এ ছাড়া সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনার বার আনতে একজন যাত্রীকে ভরিপ্রতি (এক ভরিতে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ১৫০ টাকা হারে শুল্ক দিতে হতো। সে সময় ভারতগামী এক যাত্রী ২০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনা সঙ্গে করে নিতে পারতেন। সে জন্য বিমানবন্দরে তাঁকে শুল্ক পরিশোধ করতে হতো ভরিপ্রতি ৯ হাজার টাকা। ওই সময় বাংলাদেশে ব্যাগেজ রুলের আওতায় শুল্ক কম থাকায় বিদেশ থেকে সোনা এনে বাংলাদেশ থেকে চোরাই পথে ভারতে পাচারের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ওই নিয়ম পরিবর্তন করে বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালংকার আনার সুযোগ রাখা হয়। এ ছাড়া ২০০ গ্রামের বারের ক্ষেত্রে শুল্ক আনতে ভরিপ্রতি তিন হাজার টাকা পরিশোধ করার বিধান রাখা হয়।
এনবিআরের চোলাচালান সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি সোনার চাহিদা রয়েছে তার মধ্যে ভারত অন্যতম। ভারতের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চার স্থরবিশিষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন বিমানবন্দরের তুলনায় বাংলাদেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি কম। এসব বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মীরাও সোনা চোরাচালানে জড়িত। ভারতের তুলনায় কম শুল্ক নির্ধারণ থাকায় বাংলাদেশে ব্যাগেজ রুলে এনে ভারতে প্রবেশ করালেও প্রতি ভরিতে প্রায় ছয় হাজার টাকা লাভ থাকছে। ব্যাগেজ রুলে আনা সোনার বেশির ভাগ দুবাই থেকে দেশে আসছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দিকে বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে স্থলপথে ভারতে বেশি সোনা পাচার হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা সোনা শুল্ক পরিশোধ করেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফটক পার হয়। এসব সোনার বেশির ভাগই বিমানবন্দরের বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয় এজেন্টদের কাছে। এজেন্টদের কাউকে কাউকে শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নজরদারিতে রাখলেও বৈধ পথে আনা সোনা বিক্রির আইনি অধিকার থাকায় যাত্রী বা এজেন্টদের কাউকে আটক করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের প্রায় চার হাজার কিলোমিটার অরক্ষিত থাকায় এসব এলাকা দিয়ে সহজে পাচার হচ্ছে সোনা।
এনবিআরের শুল্কনীতি শাখার সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারতে সোনার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সেখানে অনেক মানুষ সোনার সামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আমি ভারতের অনেক বড় শহর নিজে পরিদর্শন করে দেখেছি, পাঁচ-ছয়তলা ভবনের প্রায় সবটায় শুধু সোনার ব্যবসা চলছে। এনবিআর থেকে তদন্ত করে দেখা গেছে, এসব সোনার বেশির ভাগই বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশে তো সোনার খনি নেই। তাহলে এসব সোনা কোথা থেকে আসে? অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার সোনা আমদানিতে কোনো অর্থ পাচ্ছে না। ব্যাগেজ রুলে নামমাত্র কিছু পাচ্ছে। চোরাই পথে আনা সোনা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ভারতে পাচার হচ্ছে। ’
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার সোনার দোকান রয়েছে। এসবের মধ্যে প্রায় ৭০০ সমিতির সদস্য। সমিতির সাবেক সভাপতি দীলিপ রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, এ দেশে দৈনিক ১০ কোটি টাকার সোনার বাজার আছে। এলসি খুলে সোনা আমদানিতে মোট মূল্যের ৪ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। এলসি খুলে সোনা দেশে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন থেকে এক মাস। অথচ সোনার বাজারদর বিনা নোটিশে অতি দ্রুত ওঠানামা করে। এতে লোকসানের আশঙ্কা থাকে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সোনার চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় যাত্রীদের ব্যাগেজে আনা সোনায়। প্রবাসীরা বা সাধারণ যাত্রীরা দেশে আসার সময় যে পরিমাণ সোনা নিয়ে আসেন এর প্রায় অর্ধেকই বিক্রি করে দেন। আবার পুরনো সোনা ভেঙেও নতুন গয়না তৈরি হয়।
এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যাত্রী হিসেবে ব্যবসায়ীরাও ব্যাগেজে সোনা এনে ব্যবসা করছেন। ভারতে সোনা আমদানিতে শুল্ক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে সোনা এনে চোরাই পথে ভারতে প্রবেশ করাতে পারলেই লাভ।
এনবিআরের শুল্কনীতি শাখার সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে সোনা ব্যবসা আইনের মধ্যে পরিচালনা করা সম্ভব। সোনা ব্যবসায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। সোনা ব্যবসায়ীরা বন্ড সুবিধা চেয়েছিলেন। সরকার এ বিষয়ে তেমন আগ্রহী হয়নি। সরকারের উচিত ব্যাগেজ রুল নিরুৎসাহী করে আমদানি উৎসাহিত করা। প্রয়োজনে সোনার জন্য পৃথক আমদানিনীতি করা। এর আগে সোনার জন্য আমদানিনীতি কার্যকর করার উদ্যোগ নিলেও তা একপর্যায়ে থেমে যায়। এ জন্য সরকার দায়ী নাকি কোনো চক্রের ইশারায় বন্ধ হয়ে যায় তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চোরাকারবারে জড়িতরা অনেক প্রভাবশালী। বৈধভাবে সোনা আমদানি করা হলে তাদের চোরা কারবার বন্ধ হয়ে যাবে বা কমে যাবে।
এনবিআর সূত্র মতে, আটক সোনা নিলামে তুলে বিক্রির বিধান থাকলেও দীর্ঘদিন নিলাম করা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট চার হাজার ৬৩০ কেজি বা প্রায় ১১৬ মণ সোনা আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মানের ৫৭ মণ সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে আছে। অস্থায়ী খাত তথা অনিষ্পন্ন অবস্থায় জমা আছে এক হাজার ২৫৬ কেজি বা ৩১ মণের সামান্য বেশি সোনা। এর বাইরে স্বর্ণালংকার জমা আছে ৩১৫ কেজি বা প্রায় আট মণ। কিছু আদালতের নির্দেশে শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে দাবিদারদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। বাকি সোনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একজন করে প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নিলাম ডাকার কথা থাকলেও ২০০৮ সালের ২৩ জুলাইয়ের পর আর নিলামে তোলা হয়নি। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে চিঠি পাঠিয়ে আটক সোনা নিলামে তুলতে আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে আটক সোনা কোথায় কী অবস্থায় আছে তাও জানতে চাওয়া হয়। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/05/20/499259