২০ মে ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৪

নির্বাচন ও গণতন্ত্র

|| ফ র হা দ ম জ হা র ||
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার বড় একটি সময় ব্যয় হয়েছে, নির্বাচনই গণতন্ত্র- এ ধরনের অনুমান বা ধারণার আধিপত্যের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতে গিয়ে। বাংলাদেশে এ ধারণা এখনও প্রবল। যদিও আজকাল দুই-একজন এ ধারণার আধিপত্যের বিপদ কিছুটা উপলব্ধির চেষ্টা করছেন।


নির্বাচনের তর্ক মূলত গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে যুক্ত হলেও সার্বজনীন ভোটাধিকার আদায়ের আলাদা ইতিহাস আছে। সেটি সামন্ত ইউরোপে মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতি আদায়ের সঙ্গে জড়িত। সেটি রাজনৈতিক লড়াই। মানুষ স্বাধীন ও সার্বভৌম এবং নিজের ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা তার আছে, এ অনুমানও সার্বজনীন ভোটাধিকার আদায়ের ইতিহাসে ‘মানুষ’ সম্পর্কে সমাজের ধারণার ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু মেয়েদের ‘মানুষ’ হিসেবে পরিগণিত হতে পাশ্চাত্যে অনেক সময় লাগে। মেয়েদের ভোটাধিকার সহজে অর্জিত হয়নি।

অতএব সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলাদাভাবে বিচার করা জরুরি। সেটি আমরা সাধারণত করি না। ফলে এর সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্বন্ধ ঠিক কোথায় সেটি আমরা জানি না। জানতেও চাই না। সম্বন্ধের বিচার কত গুরুত্বপূর্ণ সেটি বুঝব যদি নিজেদের প্রশ্ন করি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ভোটে জিতে আসার পর পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বলে ক্ষমতাসীনরা যদি আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করে, তাহলে কি আমরা সেই শাসককে মানতে বাধ্য? যদি মানবিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়? যদি নাগরিকদের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়? মানুষ গুম হয়ে যেতে থাকে? যদি গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর লাশও খুঁজে পাওয়া না যায় কিংবা হতভাগ্যদের লাশ নদীতে ভেসে ওঠে? তাহলে কি সেই সরকার ও রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক? ধরা যাক তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন এবং তারা সর্বৈব ‘বৈধ’। তাহলে নির্বাচন ও বৈধতা দিয়ে ‘গণতন্ত্র’ আছে কী নাই তার মূল্যায়ন আদৌ সম্ভব কি?

অবশ্যই না। অসম্ভব। তাহলে এ সম্বন্ধ বিচারই আসল প্রশ্ন। নির্বাচন সেই তুলনায় গৌণ দিক। কারণ নির্বাচনী গণতন্ত্র অনায়াসেই ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে পারে। ইতিহাসই তার প্রমাণ। সেটি হিটলার-মুসোলিনির ক্ষেত্রে যেমন সত্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। হতে পারে না। যে কারণে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে যখন সরকার গঠিত হয়েছিল, তখনই আমাকে বলতে হয়েছে, জনগণ ভোট দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েম করল। সেই ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র বোঝানোর জন্য ‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’ নামে একটি পুস্তিকাও আমি প্রকাশ করেছি।

ভোটের অধিকার আমাদের দরকার, আমরা অবশ্যই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইব; কিন্তু গণতন্ত্র যদি না বুঝি, বিশেষত এর সঙ্গে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সম্বন্ধ বুঝতে অপারগ হই, তাহলে সেই অধিকার চর্চা করতে গিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাই কায়েম করব। এটাই অনিবার্য, সে কথাই আমি গত কয়েক দশক ধরে বলে আসছি। এখন যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ভোট দিয়ে হটিয়ে অন্যদের ক্ষমতায় বসালে ‘যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন’ হবে। তারপরও নির্বাচন দরকার, কিন্তু নির্বাচন বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট মোচন করতে পারবে না।

কোনো বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধতা বা পক্ষপাতে আমার আগ্রহ নাই। আমার কাজ হচ্ছে সমাজের চিন্তা ও তৎপরতার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে সেই দিকটি যথাসাধ্য পরিচ্ছন্ন করা। আমি গণক্ষমতা তৈরি ও চর্চায় আগ্রহী, সে কারণে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আমি পূজা করি না। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পর্যালোচনা ছাড়া এর সীমাবদ্ধতা আমরা ধরতে পারব না। সে কারণে যদি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই আমাদের কাম্য হয়, তাহলে নিদেনপক্ষে নির্বাচনের সঙ্গে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সম্বন্ধ বিচার করা দরকার। কিন্তু সেটি করতেও আমরা কখনই আগ্রহী ছিলাম না। এখনও নই। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পাহাড় জমে ওঠার পরও নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের কোনো আগ্রহ নাই। আগ্রহী না বলেই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র্রব্যবস্থা অনায়াসেই কায়েম হতে পেরেছে। এর জের সহজে কাটবে বলে আমি মনে করি না। যদি আমরা কাটাতে চাই তাহলে নির্বাচনী বৈধতা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সম্বন্ধ বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র, যা নিয়ে আমাদের সমাজে খুব কমই আলাপ-আলোচনা হয়। যদি ছিটেফোঁটা কিছু হয়ও তো নির্বাচনের জোয়ারে সেটি ভেসে যায়।

এই বিপদ রুখে দেয়ার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দিক থেকে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার ইতিহাসের আলোকে সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জন ও চর্চার ইতিহাস এবং তার তাৎপর্যকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি ও তাৎপর্যের আলোচনা থেকে ভিন্নভাবে তোলা ও বোঝা দরকার। রাষ্ট্রের বিশেষ ধরন হিসেবে গণতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচনের সম্বন্ধ বিচার করার ক্ষমতা অর্জন খুবই জরুরি। এর মধ্য দিয়ে আমরা আসলে কী চাই তা বিমূর্ত বিষয় না হয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিষয় হয়ে উঠবে।

এখানে মনে রাখা দরকার, নির্বাচন ছাড়া আদতে বাংলাদেশে শব্দ হিসেবে গণতন্ত্র আর কোনো অর্থই বহন করে না। অথচ ‘গণতন্ত্র’ নামক ডাকনামে কে কী বোঝে এবং কী বোঝাতে চায়, তার দ্বারা আদৌ কোনো রাজনীতি গণতান্ত্রিক নাকি গণতন্ত্রের বিরোধী সেটা আমরা বুঝব। প্রহসন যে, ‘গণতন্ত্র’ এমনই এক শব্দ যা গণতন্ত্রবিরোধীরাই হরদম ব্যবহার করে। অন্যদিকে শব্দটির উপযোগিতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও নিজেকে গণতন্ত্রী দাবি না করে জনগণের কাছে পৌঁছানো এখনও কঠিন।

দুই

আমরা ইংরেজদের কলোনি ছিলাম, এ দেশে তাদের রাজত্বের অবসান ঘটলেও আইন, রাজনীতি, রাষ্ট্র ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইংরেজ সাহেবদের ধ্যানধারণাই আমরা বহন করি। যে কারণে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম এবং পার্লামেন্টই ‘সার্বভৌম’ এটাই আমরা শিখেছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে এটাই সত্য বলে জারি রয়েছে। কিন্তু ইংরেজদের কোনো লিখিত সংবিধান নাই, আমাদের আছে। পার্লামেন্টকে সার্বভৌম বলার ঐতিহাসিক কারণ হচ্ছে, রাজা কিংবা গির্জার সার্বভৌম ক্ষমতা খর্ব করেই ইংরেজদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিংবা মসজিদ বা মন্দিরের বিরুদ্ধে লড়ে গণতন্ত্র কায়েম করিনি। গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের আগ্রহ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার তাগিদ উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে যেভাবে ভূমিকা রেখেছে তেমনি রেখেছে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রেও। পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় হিসেবে আমরা বাংলাদেশ কায়েম করেছি। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার তিনটি মৌলিক বিষয় ছিল, যার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং ইতিহাসের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই তিনটি বিষয় হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ। তাহলে বাংলাদেশে পার্লামেন্টকে ‘সার্বভৌম’ বলার আরেকটি অর্থ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও আদর্শবিরোধী নীতি ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টকে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রদান করা হতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সংসদ গঠন করতে পারলেই সেই সংসদ দিয়ে যা খুশি আইন প্রণয়ন করার অধিকার গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় স্বাধীনতার ঘোষণার বিপরীতে দাঁড়ানোও জাতীয় সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা হতে পারে না। সেটা হবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী।

বাংলাদেশের ইতিহাস যদি আমরা বিবেচনায় রাখি তাহলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারবিরোধী কোনো আইন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কায়েম করতে পারে না, কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে গাঠনিক শক্তি (Constitutive power)- অর্থাৎ নিজেদের একটি রাষ্ট্র হিসেবে পরিগঠিত করার যে সার্বভৌম ক্ষমতার ঐতিহাসিক উদয় ঘটেছে, জাতীয় সংসদ তা অস্বীকার বা বাতিল করতে পারে না। বাতিল করার অর্থ খোদ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করা।

এই তিনটি আদর্শ একইভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তি। তাহলে এর বিরোধিতা করার অর্থ বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক ঐক্য নস্যাৎ করা এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে বাংলাদেশকে ঠেলে দেয়া।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে জাতীয় সংসদ শুধু আইন প্রণয়নের অধিকারী (legislative power), কোনোভাবেই সার্বভৌম ক্ষমতার নয়। এটাও আমাদের পরিষ্কার বুঝতে হবে, যে তিন নীতির ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তার বিপরীতে কোনো গাঠনিক ক্ষমতা (Constitutive power) জাতীয় সংসদের থাকতে পারে না। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না যা সাম্য, মানবিক মর্যাদা কিংবা ইনসাফের বিরোধী। যদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিষ্ঠিত ভিত্তি কেউ পর্যালোচনা করতে চায় তাহলে রেফারেন্ডাম ছাড়া, অর্থাৎ জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা তলব করা ছাড়া সেটা করতে পারে না। যে তিন নীতির ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন কিংবা নাকচ করতে হলে নতুন গঠনতান্ত্রিক সভা (Constituent Assembly) ডাকতে হবে। গায়ের জোরে অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু ইতিহাস প্রতিশোধ নিতে দ্বিধা করে না। নতুন সংবিধান সভার জন্য নির্বাচন না করে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে নির্বাচিত প্রাদেশিক সভা ও আইনসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে যে সংবিধান প্রণয়ন করে, তাকে বাংলাদেশের সংবিধান দাবি করার পক্ষে কোনো যুক্তি নাই।

কিন্তু এই সমস্যাগুলো আমরা বুঝব না যদি নির্বাচনের সঙ্গে গাঠনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার সম্বন্ধ আমরা না বুঝি। একটি সংবিধানের অধীনে জাতীয় সংসদের ক্ষমতা কি ‘গাঠনিক’ ক্ষমতা, অর্থাৎ যে সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হয়েছে তাকে বদলে দেয়া বা অস্বীকার করা? নাকি শুধু সেই সংবিধানের অধীনে বিদ্যমান সংবিধান যতটুকু সীমা নির্ধারণ করে দেয়, সেই সীমার মধ্যে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা। গাঠনিক ক্ষমতা ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার মধ্যে ফারাক আকাশ-পাতাল। আমরা তা সততই গোলমাল করে ফেলি। রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভিত্তি বদলে দেয়ার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের থাকা উচিত নয়, বাংলাদেশের বাস্তবতায় থাকতে পারে না। একমাত্র জনগণই সেই গাঠনিক ক্ষমতার সরাসরি অধিকারী। মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একমাত্র সরাসরি গণভোটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি সম্পর্কে জনগণের মতামত দেয়াই বিচক্ষণ প্রক্রিয়া। ফলে একটি গৃহীত সংবিধানের মধ্যে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নী ক্ষমতা থাকবে; কিন্তু কখনই তা গাঠনিক, অর্থাৎ আইন প্রণয়নী ক্ষমতা নতুন রাষ্ট্র বা নতুনভাবে রাষ্ট্র বানানোর ক্ষমতা হতে পারে না।

এ ব্যাপারে আমাদের কোনো হুঁশ নাই, এমনকি সমাজে ন্যূনতম তর্ক-বিতর্কও নাই। যে কারণে কথিত সার্বভৌম জাতীয় সংসদ নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণকারী আইন অনায়াসেই প্রণয়ন করে, এমনকি নিজেদের ‘সার্বভৌম’ বলার মধ্য দিয়ে তা করার অধিকারী বলেও কার্যত দাবি করে। যেমন খুশি আইন প্রণয়নও করে। সেটা হোক তত্ত্বাবধায়ক সরকার, কিংবা পঞ্চদশ সংশোধনী। সংবিধানকে যেমন খুশি বদলিয়ে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম কোনো ব্যাপারই না। শুধু দরকার নির্বাচন এবং সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন। নির্বাচনের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্বন্ধ বিচার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, আশা করি উপরের আলোচনায় কিছুটা বোঝাতে পেরেছি।

বিলাতেও সার্বভৌম পার্লামেন্ট একটি বিতর্কিত ধারণা। এ ক্ষেত্রে আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ আলবার্ট ভেন ডাইসির মত হচ্ছে, বিলাতে পার্লামেন্ট যা খুশি আইন করতেই পারে; কিন্তু এমন কোনো আইন করতে পারে না যা পার্লামেন্ট বদলাতে পারে না। বোঝা যাচ্ছে ডাইসি পার্লামেন্টকে ব্রিটেনের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বল করতে চান না, কিন্তু তার ক্ষমতার সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়ার পক্ষপাতী। এমন কোনো আইন পার্লামেন্ট করতে পারে না, যা পরের পার্লামেন্ট বাতিল করতে না পারে। বাংলাদেশের পঞ্চদশ সংশোধনী এই মানদণ্ডে কোথায় দাঁড়ায় পাঠক তা বিচার করে দেখতে পারেন।

তিন

কিন্তু গণতন্ত্র শুধু আইন প্রণয়নী ব্যাপার নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থাৎ শাসনব্যবস্থারও একটি ধরন। রাষ্ট্রের দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে বুঝলে সুবিধা। একটি হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা, যে ক্ষমতাকে ‘সার্বভৌম’ গণ্য করা হয়। অন্যদিক হচ্ছে এর প্রশাসনিক বা শাসনের দিক। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে, অর্থাৎ যেখানে সারা দুনিয়ায় মূলত পুঁজিরই আধিপত্য বর্তমান এবং রাষ্ট্র পুঁজির পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতির উপায়মাত্র, সেখানে ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’সম্পন্ন রাষ্ট্রের ধারণা একটি চরম তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সবচেয়ে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত দেবতাতুল্য মানুষ নিয়ে গঠিত হলেও সেই রাষ্ট্র বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কিংবা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হুকুমে চলবে। কিংবা পরিচালিত হবে বহুপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতার ভিত্তিতেই। হচ্ছেও বটে। সেখানে জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের মূল্য ততটুকুই, যতটুকু তাকে নিয়ন্ত্রণ বা শৃংখলার মধ্যে আনার জন্য ‘সুশাসন’ নামক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপযোগী ছকটা ক্ষমতাসীনরা বুঝে নিতে পারে। বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে পাল্টা গণক্ষমতা, অর্থাৎ নিজেদের ভাগ্য ও অবস্থা নিজেরা নিজে নির্ধারণ করার হিম্মত অর্জন ছাড়া জনগণের সামনে সহজ কোনো পথ নাই। অর্থাৎ বিশ্ব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে রাষ্ট্র নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতেই হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে নতুন ধরনের রাজনীতি ও বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির দরকার। একদিনে সেটা গড়ে উঠবে না। এতে হতাশ হওয়ারও কিছু নাই। কিন্তু গোড়ার প্রশ্ন তুলতে ব্যর্থ হলে, কিংবা সেই প্রশ্নের প্রতি মনোযোগী না হলে আমরা বড়জোর দেশে দেশে সস্তা শ্রমিক সরবরাহ করে ‘মধ্য আয়ের দেশ’ হওয়ার নিষ্ঠুর তামাশা করতেই পারি। কিন্তু সব কিছুরই যেমন শেষ আছে, এই তামাশারও যবনিকা হবে।

নতুন চিন্তা হাওয়া থেকে জন্ম নেবে না। সমাজে বাস্তব লড়াই-সংগ্রাম থেকেই তার উদয় ঘটবে। ক্ষমতা, শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রকাঠামো, সমাজ, ব্যক্তি ইত্যাদি নিয়ে বৃহৎ পরিসরে আলোচনা করা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের ভূমিকার বিচার অসম্ভবও বটে। কিন্তু সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা দূরে থাকুক, নির্বাচনই গণতন্ত্র এই ধারণার আধিপত্য এখনও আমাদের সমাজে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনাকে পক্ষাক্রান্ত করে রেখেছে।

আমার ধারণা, নির্বাচন-রাজনীতি-রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে এখন অতীতের চেয়ে কঠিন। কারণ এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নির্বাচনী অর্থনীতি। বাংলাদেশের লুটেরা শ্রেণী আইনি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত রাখতে চায়। গত কয়েক দশকে লুটেরা শ্রেণীর বড় একটি অংশ টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নির্বাচনী টিকিট কেনে এবং তাদের লুটের টাকার একটা অংশ নির্বাচনে ব্যয় করে। এটা তাদের দিক থেকে বিনিয়োগ। জিততে পারলে যে ক্ষমতা তারা হাতে পায় তা তাদের আরও ধনী করে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে লুটতরাজের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে আরও বিপুল পরিমাণ অর্থ এতে কুক্ষিগত করার একটা প্রক্রিয়া তারা গড়ে তুলেছে। কালো টাকার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন যত আইনই করুক, গ্রামে গ্রামে নির্বাচন কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের সঞ্চালন ঘটে। যার কারণে কালো টাকার অর্থনীতি এবং কালো টাকার মালিকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়া জারি রাখা এখন খুবই সহজ। এই চক্র থেকে বাংলাদেশের জনগণকে বেরিয়ে আসতে হলে যে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকা জরুরি, আমরা তা গড়ে তুলতে পারিনি।

কিন্তু চিত্রপট থেকে সংকটটিকে শনাক্ত করতে পারাটাই প্রথম কাজ।

১৯ মে ২০১৭। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪। শ্যামলী।

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/05/20/126068/