১৯ মে ২০১৭, শুক্রবার, ১০:১৮

গ্রিক মূর্তি সরানোর দাবির যৌক্তিকতা

|| মো: ইখতিয়ার উদ্দিন রিবা ||

তথ্য মতে, ‘গ্রিকদের প্রাচীন ধর্মে থেমিস ছিলেন বিচারের রূপক, ন্যায়বিচারের দেবী, ভালো উপদেষ্টা ও দেবতাদের অভিলাষের ব্যাখ্যাতা। কতক সূত্রে তাকে স্বর্গ (Urenus) এবং পৃথিবীর (Gaea) কন্যা বলা হলেও কখনো কখনো দৃশ্যত পৃথিবীর অভিন্ন বলা হয়েছে। তিনি প্রধান দেবতা জিউসের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তারই ঔরসজাত দুই সন্তানের জননী।
অলিম্পাসে (গ্রিসে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, যেখানে জিউসের মন্দির) তিনি রীতিনীতি রক্ষাসহ সব পর্বাদি তত্ত্বাবধান করতেন এবং দৈববাণী দিতেন। দেবী থেমিসের প্রতি এই বিশ্বাসের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে গ্রিসে। সংযমী চেহারার ও দাড়িপাল্লা বহনকারীর প্রতীক রূপে প্রায়ই তাকে প্রদর্শিত করা হতো।’ (Micropaedia, Vol-IX, P-930)
বিবর্তিতকাল, সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পর্যায়ক্রমে গ্রিসে আবির্ভাব ঘটে অনেক কবি, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকের। ফলে চিন্তাচেতনা ও বিশ্বাসে ক্রমেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। অবশ্য তাও অন্তত কবি হোমারের (আনুমানিক ৮৫০ খ্রি. পূর্বাব্দ) পরবর্তীকাল হতে। ‘আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে (৬২০ খ্রিষ্টপূর্বও বলা হয়) এথেন্সে দ্রাকোন সর্বপ্রথম সঙ্কলন করেন কঠোর আইন, যা তার নামেই খ্যাত ছিল। মামুলি থেকে গুরুতর প্রায় সব অপরাধেই তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেন। পরে এথেন্সের দক্ষ শাসক, শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও খ্যাতিমান কবি সলোন (Solon) (আ: ৬৩৮-৫৫৯ খ্রিষ্টপূর্ব) দ্রাকোনিয়ান প্রায় আইনের সংস্কার করেন। বিশেষত খুন হওয়া ব্যক্তির পরিবারের পরিবর্তে খুনের দণ্ড প্রদানের ভার অর্পণ করা হয় রাষ্ট্রের হাতে। শুধু শিল্প-সাহিত্যই নয়, গ্রিক পুরাণ থেকেও আধুনিক বিশ্ব অনেক লাভবান হয়েছে। গ্রিক দেবতা ও উপদেবতার নামে বর্তমানের আবিষ্কৃত গ্রহ-নক্ষত্র, এমনকি রকেটের নামকরণে প্রাচীন ধারাকেই অব্যাহত রাখা হচ্ছে। বস্তত, গ্রিক পুরাণের এসব ব্যক্তিত্বের নাম অসংখ্য লেখনী ও বিজ্ঞাপন থেকে সিনেমায় এখনো টিকে আছে।’ (Encyclopaedia, V-8, P-402, Micro.V-III, P-651)
এমন ব্যবহার কোথাও দেবত্বের বিশ্বাসে নয়Ñ একান্তই নামের। গ্রিকদের চিরতরুণ সূর্য দেবতা ছিল অ্যাপোলো। আধুনিককালে তার নামধারী মহাকাশ যান বা কোনো প্রতিষ্ঠানই সেই গুণবাচক প্রতীকী নয়। পক্ষান্তরে চেহারার মিল না থাকলেও কোথাও কোনো বিচারালয়ের অঙ্গনে স্থাপিত দেবী থেমিসের মূর্তি প্রত্যক্ষই তার দেবিত্ব গুণাগুণের স্বীকৃত প্রতীকী বলা যায়Ñ তাই খুঁজে পাওয়া যায় না একে ভাস্কর্য বলার যৌক্তিকতা।
প্রাচীন যুগেও জ্ঞাত পৃথিবীর সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়াও কিছু না বিশ্বাস ও প্রথা অনুকরণীয় হয়েছে। ভারতীয়দের কাছে গ্রিকরা অপরিচিত ছিল না। গ্রিক ভাষায় পাতার ও মাতার হলো সংস্কৃত পিতার ও মাতার অর্থাৎ পিতা ও মাতা। গ্রিক হেপতা হলো সংস্কৃতে সাপটাÑ অর্থাৎ সাত এবং নিওজ হলো সংস্কৃত নভাস অর্থাৎ নতুন। গ্রিক বীর আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর তার এশীয় সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল অধিপতি সেলুকাস-১ নিকটরের (Seleucas-1 Nicator) সাথে ভারতের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (রাজত্বকাল ৩২১-২৯৭ খ্রিষ্ট পূর্ব) যুদ্ধ হয়েছিল। সন্ধির সূত্রে সেলুকাসেরই বা তার বংশীয় কন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ করার কথা কোনো কোনো ভারতীয় ইতিহাসে বলা হলেও ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞদের তথ্যের স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। তবে পাটালিপুত্রে (আধুনিক পাটনা) চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় ৩০২ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে বেশ কিছু দিন ছিলেন গ্রিক দূত ও ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিস (Megathenes)। তিনি ফিরে গিয়ে ভারত সম্বন্ধে ‘ইন্ডিকা’ নামে চার খণ্ডের একখানা বই লিখেন। তাই সেকালে বা একালেও ন্যায়বিচারজনিত অনুরূপ গ্রিক দেবিত্বের প্রবর্তন বা প্রতীকী ভারত গ্রহণ করলেও বিস্তৃত হওয়ার নয়। কিন্তু অপ্রিয় সত্যটি হলো, এই উপমহাদেশীয় ইতিহাসের নিরিখে আমাদের কারো কাছেই এটা সমর্থনযোগ্য হওয়া উচিত নয়। তথ্য মতে, দেবী থেমিসের মূর্তিটি বর্তমানে রয়েছে এথেন্সের জাতীয় পুরাতত্ত্বের জাদুঘরে। তাই গ্রিকদের পুরাতত্ত্বকে আমাদের আধুনিকত্বে পুনরুজ্জীবিত না করে মূর্তিটিকে সরানোই শ্রেয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/221003