গতকাল বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির উদ্যোগে রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কয়লার ছাই অপসারণে সম্ভাব্য বিপদাপন্ন পরিবেশ নিরূপণ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় -সংগ্রাম
১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:১৫

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইয়ের দূষণে বছরে ৮শ’ কোটি টাকার মাছ মারা যাবে

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বের হওয়া ছাইয়ের দূষণে বছরে ১০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ টাকার মাছ মারা যাবে। (টাকার হিসেবে তা প্রায় ৮’শ কোটি টাকা) বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে ৬০ বছরে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন ছাই বের হবে। যার ১ কোটি ৮০ লাখ টন ছাই বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হবে। বাকি দুই কোটি টন ছাই পুকুর বানিয়ে সেখানে ফেলা হবে যা যেকোনো সময় ঝড় বা বন্যার কবলে পড়ে পুরো সুন্দরবন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে খুলনা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দূষণ বিশেষজ্ঞ এ ডেনিস লেমনির রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার ছাইয়ের দূষণ নিয়ে করা এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি-র উদ্যোগে গতকাল বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি গোলটেবিল কক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশেষজ্ঞ মিঃ এ ডেনিস লেমলি স্কাইপের মাধ্যমে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক এডভোকেট সুলতানা কামাল এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনের জাতীয় কমিটির শরিফ জামিল, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোগেণ বক্তব্য রাখেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ মিঃ এ ডেনিস লেমলি বলেছেন, রামপালে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই অপসারন ও ব্যবস্থাপনা সুন্দরবনের পানিবাহী নদীতে ও খালগুলিতে বিষাক্ত ভারি ধাতু যোগ করবে। এতে বিশ্ব ঐতিহ্য সাইট ও বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনকে, বিভিন্ন জলজ প্রজাতিসমূহকে এবং হাজার হাজার গরীবের খাদ্যের যোগান দাতা মৎস্যসম্পদকে বিপন্ন করে তুলবে। মাছ, বন্যপ্রাণী ও জনগণের উপর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্রমপুঞ্জিভূত স্বাস্থ্য ঝুঁকি ¯পষ্ট, গুরুতর, সহজ অনুমেয় ও অবশ্যম্ভাবী।
মিঃ এ ডেনিস লেমলি তার উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশের রামপালে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৯০% উৎপাদন দক্ষতায় ৬০ বছর কর্মক্ষম সময়ে ৩৮ মিলিয়ন টনেরও বেশী ছাই উৎপাদন করবে। ‘ছাই পুনঃব্যবহার পরিকল্পনা‘ অনুসারে শুধুমাত্র কয়লার ছাইয়ের একটি মাত্র অংশ গৃহস্থালীর কনক্রিট ও ইট তৈরীর কারখানায় ব্যবহার করা হবে। এ থেকে বুঝা যায় যে, অর্ধেক ফ্লাই অ্যাস সিমেন্ট ও ইট তৈরীতে ব্যবহার করলেও ছাই বর্জ্য রাখার পুকুরটি ১২ বছরের মধ্যে ভরে বা পূর্ণ হয়ে যাবে; আরও কমপক্ষে ২০ মিলিয়ন টন ছাই অপসারনের জন্য বাকি থাকবে যা অতিরিক্ত ৫০০ হেক্টর জায়গায় গর্ত ভরাট, রক্ষা-আস্তর ছাড়া ভরাট ও সারফেস ডাম্পিং করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এই পদ্ধতিগুলো স্টেট-অব-আর্ট পদ্ধতি থেকে অনেক দূরে, এবং সবগুলো পদ্ধতিই সুন্দরবনের চারিদিকে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানিকে একাধিক ভাবে ও স্থানে দূষিত করবে। বর্তমানে বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উপর পরিচালিত অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলে উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত ঝুঁকির প্রমাণ পাওয়া যায়, যা অবশ্যম্ভাবী সর্বোচ্চ পরিনাম। অধিকন্তু, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মক্ষম সময়ের মধ্যে ৭.৪ মিটার উচুর জলোচ্ছ্বাস ছাই রাখার পুকুরের দেয়ালকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে, যার সম্ভাব্য ফলাফল হবে বিপর্যয়কর ব্যর্থতা ও ছাইয়ের ব্যাপক স্পিল। উপরন্তু, ভারি বর্ষণ ও মৌসুমী বন্যা ছাই-বর্জ্যরে পুকুরকে ছাপিয়ে দেবার কারণ হবে, ফলে বিপুল পরিমানের দূষিত পানি বানের জলের মাধ্যমে মুক্ত হয়ে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে যাবে।
এ ডেনিস লেমলি বলেন, পূর্বাভাসকৃত ছাই উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে দেখা যায় রিসাইক্লিং ও অপসারনের পরে ছাই পুকুর ১২ বছরে পূর্ণ/ভরে যাবে (প্লান্ট লাইফ ৬০ বছর), ৪৮ বছরের অতিরিক্ত ছাইয়ের জন্য নির্মাণ বা সাধারণ ভরাট ব্যতিত কোন জরুরী ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নাই, পৃথিবীর বিভিন্ন সাইটের উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে এ ছাই অপসারন পদ্ধতি স্বল্প সময় ধরে বা দীর্ঘ সময় ধরে বিপুল পরিমানে বিষাক্ত দূষক অবমুক্ত করে।
তিনি বলেন, ইকোসিস্টেম তুলনামূলকভাবে শান্ত ও স্বল্পবেগে প্রবাহিত পানি হওয়ায় সেলিনিয়ামের সর্বোচ্চ বায়োঅ্যাকুমুলেশান ও বিষাক্ততার জন্য সর্বোত্তম অবস্থার সৃষ্টি করবে। ঐ একই কারনে পলিমাটির তলানীতে বেশী মাত্রায় সেলিনিয়াম জমা হবে, যা দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি তৈরী করে কারণ পলির তলানীতে যুক্ত সেলিনিয়াম রিসাইকেল হয়ে খাদ্য চক্র এবং মাছ ও বন্যপ্রাণীতে ফিরে আসতে পারে, সম্ভবত দশকের পর দশক পরেও ঘটতে পারে যদি সেলিনিয়াম সরবরাহ বন্ধ করে দেয়াও হয়। বৈজ্ঞানিক প্রমাণের একটি বড় অংশ ইঙ্গিত দেয় যে, প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই মাছ ও বন্যপ্রাণীর উপর অবশ্যম্ভাবী মারাত্বক বিষাক্ততার সৃষ্টি করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, যে কোন কয়লা প্ল্যান্টেই প্রচুর পরিমাণ ছাই উৎপাদন হয় এবং এই ছাইটা একটা দূষণ। সেলেনিয়াম বলে যে ভারি ধাতু রয়েছে এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর দূষণ এবং এর ফলে মাছগুলো বিকৃত হয়ে যাবে, প্রাণীগুলো তাদের প্রজনন ক্ষমতা হারাবে। এই প্রমান বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় রয়েছে। আমরা রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করছি যথেষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের সূত্রে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণও তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন এই প্রকল্পের কুফল বিষয়ে। আমরা নিজেদের স্বার্থে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছি না, শুধুমাত্র সুন্দরবনকে বাঁচানোর স্বার্থেই রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করছি।
ঢাবি’র প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম আবুল বাশার বলেন, প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবন-জীবিকার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে কখনই মানুষের স্বার্থ রক্ষা হয় না। তাই জনগনের স্বার্থ রক্ষার জন্যই সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে এবং সুন্দরবন বিনাশী প্রকল্প বন্ধ করতে হবে।
উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আজিজ বলেন, বৈজ্ঞানিক তথ্যমতে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এর বিষাক্ততা সাগর-নদী ও মাটির সাথে মিশে এতে মাছ-শাকসবজিসহ কৃষিজমিতেও বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়বে। এর কুফল ভোগ করবে সমগ্র জাতি। তাই ভবিষ্যত সুস্থ্য প্রজন্মের স্বার্থেও রামপাল প্রকল্পটির বিষয় সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে এর প্রভাবে বড় ধরণের হুমকীর সম্মুখীন হবে সুন্দরবন, যা পুরো জাতিকেই ভোগ করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত, সুন্দরবনের পাশে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে এটা শুধু এই এলাকা নয়, সারাদেশেই এর প্রভাব পড়বে। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক যুক্তিভিত্তিক মতামত হচ্ছে: রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে। তাই এই প্রকল্প বাতিল করতে সরকারের প্রতি আবারও আহবান জানান।

 

http://www.dailysangram.com/post/284188-