১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:০১

স্বল্পমেয়াদি নীতির ফাঁদে বস্ত্র ও পোশাক খাত

উৎসে কর কমিয়ে বাজেটে বিনিয়োগ সহায়ক পদক্ষেপ দাবি

বস্ত্র ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ সহায়ক পদক্ষেপ দাবি করেছেন। খাতটির গতিশীলতা ধরে রাখতে ৫ বছর মেয়াদি একটি রাজস্ব নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। রাজস্ব নীতির ঘন ঘন পরিবর্তন না করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট হারের শুল্ক, কর ও মূসক নির্ধারণও তাদের অন্যতম দাবি। তবে এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকে উৎসে কর নিয়ে বস্ত্র ও পোশাক খাতের আতঙ্কের কথা তুলে ধরে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা এ কর আরও কমানোর দাবি জানিয়েছেন।
বর্তমানে হরেক বাধায় পদে পদে বিপর্যস্ত বস্ত্র ও পোশাক খাত। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক দু’ভাবেই এসব বাধা এ খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। খাতটির উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, দেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব নীতির বিরাট ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রতি বছর বাজেট এলেই রাজস্ব খাতের সম্ভাব্য সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস নিয়ে আতঙ্কে ভোগেন তারা। কারণ বাজেটের মাধ্যমে সরকারি আয় বাড়াতে প্রতি বছরই মূসক, কর ও শুল্ক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এতে সরকারের স্বল্পমেয়াদি অনেক পদক্ষেপের সুফল যাচ্ছে না উদ্যোক্তার পকেটে। এর বাইরে অবকাঠামোগত নানাবিধ সংকটও প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
এদিকে অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিও এ দুটি খাতের স্বাভাবিক বিকাশের অনুকূল অবস্থায় নেই। কমছে পণ্যের চাহিদা। বাড়ছে না দাম। এরপরও থেমে নেই স্বার্থান্বেষীদের অপতৎপরতা। দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম ডলার, রুবল ও পাউন্ডের মূল্যে ধস সব হিসাব-নিকাশকেই পাল্টে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারছেন না। অনেকেই ব্যবসা থেকে সটকে পড়েছেন। একই কারণে বিদ্যমান কারখানা সম্প্রসারণ উদ্যোগও আটকে আছে। কমে গেছে নতুন বিনিয়োগ আসার হার। এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। কমছে রফতানি আয়। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক তৈরি পোশাক কারখানা এবং তার উপকরণ সরবরাহকারী বস্ত্র ও সুতাকল। সব মিলিয়ে খাতটির সেই সম্ভাবনার জায়গাটি অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেয়া বস্ত্র ও পোশাক খাতের পৃথক বাজেট প্রস্তাবে কর্পোরেট কর হার হ্রাস, কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রদান এবং রফতানিতে উৎসে কর বন্ধ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একের সঙ্গে অপরের যে দ্বৈতনীতি রয়েছে- তারও প্রত্যাহার দাবি করে তারা অবকাঠামোগত নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কথাও তুলেছেন। অভিযোগ করেছেন, ইচ্ছে হলেই একটা ঘোষণা দিয়ে যখন-তখন গ্যাস-বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট ও ঘনমিটারের দাম বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এসবের সরাসরি প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে। বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসার ব্যয়। বাড়ছে পণ্যের দামও। বিপরীতে পোশাকের প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ার কথা জানান তারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘উৎসে কর বন্ধ করে দেয়া উচিত। তা না হলে অন্তত ২ বছরের জন্য এটি বন্ধ করা উচিত।’ তবে এটি তার মৌখিক বক্তব্য হলেও এনবিআরকে দেয়া লিখিত প্রস্তাবে বিজিএমইএ উৎসে কর শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা এবং তা আগামী ৫ বছর কার্যকর রাখাসহ কর দায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে। গত ১০ বছরে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশ। এখন সেটি ২ শতাংশে নেমে এসেছে। তার ওপর গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও অবকাঠামোতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব মোকাবেলা করতে না পেরে প্রায় ১২শ’ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আগামী ২ বছর টিকে থাকতে পারলে পোশাক খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেন, ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের কারণে রফতানি খাতকে ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই ৫ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করা দরকার। তাহলে প্রতি বছর ব্যবসায়ীদের আর দাবি-দাওয়া নিয়ে আসতে হবে না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি আসলাম সানি যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও রফতানি খাতে উৎসে কর নেই। সুতা-কাপড়, রংসহ বিভিন্ন পর্যায়ে একটি পোশাক প্রক্রিয়াজাত করার আগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুল্ক-কর দিতে হচ্ছে। এরপর রফতানি মূল্যের ওপর দশমিক ৭০ শতাংশ উৎসে কর দিতে হচ্ছে। যা রফতানিকারকদের কাছে বোঝার মতো। এটিকে কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা উচিত। পাশাপাশি কর্পোরেট ট্যাক্স ১০ শতাংশ হ্রাসকৃত হারে ৫ বছরের জন্য নির্ধারণ করা উচিত। রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, উৎসে কর নিয়ে আতঙ্কে থাকি। এটিকে ৫ বছরের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। তাহলে আর প্রতি বছর দেন-দরবার করার দরকার নেই। তিনি আরও বলেন, মাঝে মধ্যে রফতানি খাতকে সহায়তা দিতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু সেটি শুধু বিজিএমইএ পায়, বাকি রফতানিকারকরা এ সুবিধা পান না। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) মহাসচিব ফিরোজ আহমেদ বলেন, আয়করের ৮২সি অনুযায়ী লাভ-লস নির্বিশেষে ন্যূনতম করের বিধান আছে। এটি বাতিল করা উচিত। তাছাড়া ব্যক্তি শ্রেণীর সর্বোচ্চ করসীমা ৩০ শতাংশ আছে। সারচার্জসহ একজন ব্যক্তিকে ৩৭ থেকে ৩৮ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে। তাই সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে ২৫ শতাংশ করারও প্রস্তাব রাখেন তিনি।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/05/18/125425/