১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৭

সংবাদ বিশ্লেষণ

সরকারি ব্যাংক বাঁচাবে কে

দেশের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ধ্বংসের পথে। এর আগে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা নামের দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংস করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বেসিক ব্যাংককেও। 

একের পর এক সরকারি ব্যাংক ধ্বংসের জন্য সরকার নিজেই মূলত দায়ী। সরকার এসব ব্যাংককে জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য নয়, বরং সমর্থক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ধনী ও নব্য ধনীদের সুবিধা দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে রেখেছে। এই কাজে যাঁরা সহায়তা দিতে পারবেন, তাঁদেরই উচ্চ পদে বসানো হয়েছে। এ কারণেই এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়। কেউ কেউ ছয় বছরের বেশি সময় ধরে এমডি থেকে যান।
সরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কাজ করে রাজনৈতিক বিবেচনা। পর্ষদে স্থান পান দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। ব্যাংকের এসব পর্ষদ চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরাও হয়ে যান অনিয়মের সহায়তাকারী ও দর্শক। সরকারি মালিকানায় থেকেও একসময় বেসিক ব্যাংক শিল্পসচিবের নেতৃত্বে একটু ভিন্ন ব্যবস্থায় চলত। ২০০৯ সালে সেখানেও চেয়ারম্যান করা হয় শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর মতো জাতীয় পার্টির একজন মধ্যম সারির নেতাকে। তাঁর নেতৃত্বে ব্যাপক লুটপাটের কারণে বেসিক ব্যাংক এখন মৃতপ্রায়। সাইমুম সরওয়ার ছিলেন কক্সবাজার আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতা। তাঁর মতো এ রকম আরও কয়েকজন নেতা-কর্মীকে পর্ষদের সদস্য করা হয় সরকারি ব্যাংকগুলোতে।
টানা ছয় বছর অগ্রণী ব্যাংকে এমডি হয়ে থাকলেন সৈয়দ আবদুল হামিদ। পদে থাকা অবস্থাতেই নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে প্রথম আলোসহ অন্য জাতীয় দৈনিকগুলোতে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে শেষ সময়ে এসে মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র এক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক লোক দেখানো পদক্ষেপ হিসেবে সৈয়দ আবদুল হামিদকে অপসারণ করে। এখন তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত। দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। এরপর জামিন নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের আরেক সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরও পলাতক। তিনিও দেশ ছেড়েছেন। আরেক সরকারি ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামও পলাতক ও দেশছাড়া।
বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বেশ কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ সরকারি ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত এ জন্য কেউ শাস্তি পায়নি। আর দুদকের মামলায় বেসিক ব্যাংকের শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নামই নেই। বিচার বা দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে সরকারের আগ্রহ যে কম, তা-ও স্পষ্ট। আত্মসাৎ করা পুরো অর্থই ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়। সব ব্যাংকই এখন তথ্যপ্রযুক্তির দিক থেকে উন্নত। সুতরাং কোন ব্যাংক হিসাব থেকে কী পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, অর্থ কোথায় কোথায় গেছে, কার হিসেবে স্থানান্তর করা হয়েছে, তা চাইলেই বের করা সম্ভব। কিন্তু এই কাজটি করা হয় না। বলা যায়, আত্মসাতের সঙ্গে কারা জড়িত এবং পেছনের সহায়ক কারা ছিলেন, তা খুঁজে বের করার কোনো সদিচ্ছাই সরকারের ছিল না। আর দুদকও পরিণত হয়ে আছে হুমকিসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে। শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে দায়ী করে অর্থমন্ত্রী একাধিকবার সংসদ ও সংসদের বাইরে কথা বললেও এখনো দুদকের কোনো নড়াচড়া নেই।
সরকারি ব্যাংক ধ্বংসের জন্য সরকারের দায় আরও আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এরপরও তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি সরকার। যদি কখনো কোনো কারণে সরকারের মনোভাব না বুঝে একটু বেশি নজরদারি করে ফেলে! এ কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো দেখভালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে আবার কবর থেকে উঠিয়ে আনা হয়। ফলে ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ আরও সহজ হয়ে যায়।
আবার বাছবিচার না করে ঋণও দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এসব অর্থ এখন আর ফেরত আসছে না। বড় বড় খেলাপিকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ সুবিধা। ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। এ নিয়ে ১৫ মে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা ছিল, কেবল ২০১৬ সালেই সরকারি চার ব্যাংকে নতুন করে ঋণ খেলাপি হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। এটি ব্যাংকগুলোরই নিরীক্ষিত হিসাব থেকে পাওয়া। ধারণা ছিল, প্রতিবেদন প্রকাশ করার পরে ব্যাংকগুলো করণীয় নিয়ে আলোচনা করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তাগাদা দেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সে রকম কিছুই দেখা গেল না; বরং সংবাদপত্রে কেন প্রতিবেদন হচ্ছে, কী এর উদ্দেশ্য—তা নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগলেন কোনো কোনো এমডি। এক এমডি তো সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে ফোন করে রীতিমতো কৈফিয়তও চাইলেন।
আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বাঁচুক। কারণ, এই ব্যাংকগুলো চলে জনগণের আমানত ও করের টাকায়। সেবার মান ভালো না হলেও সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে সরকারি ব্যাংকে আমানত রাখে। অনেকেই মনে করে, সরকারি ব্যাংক বলেই আমানতের অর্থ খোয়া যাবে না। অথচ দেখা যাচ্ছে, আমানত নিয়ে নয়ছয় হচ্ছে অহরহ। আর সেটি যে কত ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে, তার প্রমাণ হচ্ছে ১৭ মের প্রথম আলো। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে খেলাপি ঋণ এখন প্রায় সাড় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। চিত্রটি আঁতকে ওঠার মতোই।
সরকারি ব্যাংকগুলোতে এমডি বদল হয়েছে। তাঁরা তিন বছর এই পদে থাকবেন। খেলাপি ঋণের তথ্য কেন বের হলো, তা খুঁজে বেড়ানোর কাজ তাঁদের নয়। তা না করে খেলাপি ঋণ কমানোসহ ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে কী করবেন, সে কৌশল নির্ধারণ করাই ভালো। তা না পারলে মেয়াদ বাড়াতে প্রভাবশালী মহলে দৌড়াদৌড়ি করাটা ঠিক নয়। কেননা, সরকারি ব্যাংকের এমডিদের পলাতক জীবনযাপন করার উদাহরণ এখন একাধিক।
তবে ব্যাংকগুলো বাঁচবে কি না, তা মূলত নির্ভর করছে সরকারের ওপর। কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া এই কাজ করা যাবে না। নিয়োগ পদ্ধতি থেকে শুরু করে নজরদারি করা পর্যন্ত অনেক কিছুরই পরিবর্তন করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে কি না—সন্দেহ এখানেই।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1184511/