১৮ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:১০

মিলছে না চারলেন সুবিধা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার

 চার লেনের মহাসড়কের সব সুবিধা নিমিষেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। নিষিদ্ধ সত্তে¡ও মহাসড়ক ধরেই ছুটে চলছে নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার। কখনও সোজা, কখনও উল্টো পথে। বাড়ছে ঝুঁকি, বাড়ছে দুর্ঘটনা। অথচ এই ঝুঁকি এবং দুর্ঘটনা কমানোর জন্যই ২০১৫ সালের ১ আগস্ট দেশের ২২টি মহাসড়কে সব ধরণের থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। ভুক্তভোগিদের মতে, স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এবং কার্যকর তদারকির অভাবে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাচ্ছে না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জোরালো কোনো পদক্ষেপও নেই। এতে করে অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের কোনো সুবিধা মিলছে না। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ১৯২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে সরকারের খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় ২৩টি সেতু, ২৪২টি কালভার্ট, ৩টি রেলওয়ে ওভারপাস, ১৪টি সড়ক বাইপাস, ২টি আন্ডারপাস, ৩৪টি স্টিল ফুটওভার ব্রিজ এবং ৬১টি বাস-বে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর অংশ ইতিমধ্যে আটলেনে উন্নীত করা হয়েছে। যার মধ্যে এক লেন করে ইতোমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক প্রফেসর ড. শামসুল হক বলেন, আমরা উন্নতির কথা বলবো, বড় বড় সিদ্ধান্ত নিবো কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবো না-এটা অনেকটা তামাশার মতো হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলবে না- সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তখন সেখানে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এটা তাদের জন্য একটি ম্যান্ডেটরি ফাংশন। এখন তারা এর দায় এড়াতে পারেন না। জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি এম এ মালেক গতকাল ইনকিলাবে বলেন, মহাসড়ক হলেই তা হাইওয়ে পুলিশের আওতায় পড়ে তা নয়। যেমন পৌরসভা এলাকা আমাদের আওতাভুক্ত নয়। দেখা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের থ্রি-হুইলারগুলো সুযোগ পেলেই পৌরসভা এলাকার মহাসড়কে উঠে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এগুলো বন্ধ করার জন্য। তবে পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ আরও জোরালো করতে হবে।
মহাসড়কে থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের ২১ মাস পেরিয়ে গেছে। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলছে আগের মতোই। ২০১৫ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করার কিছুদিনের মধ্যেই তা কার্যকর হয়েছিল। আবার চালু হয়েছে নীরবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের জন্য আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আগে মহাসড়কে শুধুমাত্র সিএনজি অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ ব্যটারিচালিত থ্রি হুইলার চলাচল করতো। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য মোটরচালিত রিকশা। এগুলোর আবার চলার কোনো গতিপথ নেই। কখনও সোজা পথে চলে কখনও চলে উল্টো। এতে করে ঝুঁকি এবং দুর্ঘটনা দুটোই বাড়ছে।
নিরাপদ সড়ক চাই-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে মারা গেছে ৪ হাজার ১৪৪ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ২২৫ জন। এ হিসাবে ওই বছর প্রতিদিন সড়কে গড়ে প্রায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অশিক্ষিত চালক, ক্রটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যাবস্থাপনা, জনগণের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তার অপর্যাপ্ততা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইন ও তা যথারীতি প্রয়োগ না করার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাব মতে, ২০১৫ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৩৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই দুই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে প্রাণহানির সংখ্যাও। অথচ সরকার মহাসড়কে থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধ করেছিল দুর্ঘটনা কমানোর জন্যই।
ভুক্তভোগিদের মতে, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার শুধু যে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে তা নয়, এগুলোর কারণে কোনো যানবাহনই স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। এতে করে জ্বালানী খরচ, সময় সবই বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে যানজট, ভোগান্তি। পরিবহন মালিকরা মহাসড়কে এসব অবৈধ যান চলাচলের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এবং কার্যকর তদারকির অভাবকে দায়ি করেছেন। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, মহাসড়কের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ এসব অবৈধ যানবাহন। এসবের কারণে যানজট হয়, বাস স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। সময় নষ্ট হয় বলে খরচও বাড়ে। তাই আমরা চাই এগুলো বন্ধ হোক। এজন্য সরকারের সাথে মালিক সমিতির বহুবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই এসব বন্ধ হচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের এক বাস কোম্পানীর পরিচালক মাসুদুর রহমান বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানগুলো বন্ধ করতে না পারাটা দুঃখজনক। এতো টাকা খরচ করে এই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরও যদি এর সুফল পাওয়া না যায় তাহলে এটা করে লাভ কি হলো? আলাপকালে তিশা বাস সার্ভিসের এক বাস চালক বলেন, চার লেনের মহাসড়ক মানে একটা গাড়ি নির্বিঘেœ চলবে। কিন্তু ঢাকা থেকে ছাড়ার পর কাঁচপুর ব্রীজ পার হলেই ভয়াবহ যানজটে পড়তে হয়। মেঘনা সেতু পার হতে গেলে কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় নষ্ট। এরপর আছে গোমতী সেতু। সেখানেও একইভাবে সময় যায়। এরপর গৌরীপুরে মহাসড়কের উপরেই লোকাল বাস দাঁড়িয়ে থাকার কারণে সেখানেও ১০/১৫ মিনিট সময় নষ্ট হয়। তিনি বলেন, চার লেন মহাসড়ক ধরে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে চার ঘণ্টা সময় লাগার কথা। কিন্তু সেখানে ৬/৭ ঘণ্টাও লেগে যায়। এতে করে চাল লেনের সুবিধা ¤øান হয়ে যাচ্ছে। সরকার একটু আন্তরিক হলেই জনগণকে এই চার লেনের সুবিধা ভোগ করার সুযোগ দিতে পারে। মহাসড়কের গৌরীপুর অংশে লোকাল বাস, থ্রি-হুইলার দাঁড়ানোর কারনে সৃষ্ট যানজট প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি এম এ মালেক বলেন, ওই অংশ আমাদের আওতাভুক্ত নয়। এটা জেলা পুলিশের দায়িত্ব।
আলাপকালে কয়েকজন অটোরিকশার চালক জানান,মহাসড়কে চলতে গেলে মাঝে মধ্যে পুলিশের অভিযানের মুখে পড়তে হয়। তবে অভিযান থেমে গেলে পরিস্থিতি ফিরে আসতে আর সময় লাগে না। অটোরিকশার চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ যান মহাসড়কে চলাচলের নেপথ্যে সরকারদলীয় এক শ্রেণির নেতারা জড়িত। তারাই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এসব চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়। এজন্য মালিক অথবা চালকদের কাছে থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করেন তারা। এই মাসোহারার ভাগ পায় সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ। ঢাকা-মাওয়া সড়কের বেশ কয়েকজন চালক বলেছেন, টাকা না দিলে পুলিশ কখনওই মহাসড়কে উঠতে দেয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে কুমিল্লার ময়নামতি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকায় নিয়মিত অটোরিকশা চলাচল করে। কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড ও সুয়াগাজী, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়াবাজার, আদর্শ সদর উপজেলার নন্দনপুর, আলেখাঁরচর ও ময়নামতি সেনানিবাস এলাকা এবং বুড়িচং উপজেলার সাহেববাজার এলাকায় মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করে। এমনকি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কেও অবাধে সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে বলে স্থানীয়রা জানান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ে হাজার হাজার সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে। অন্যদিকে, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে নির্বিঘেœ থ্রি হুইলার চলাচল করে। স্থানীয়রা জানান, মাঝে মাঝে পুলিশ এই এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিএনজি অটোরিকশাসহ ইজিবাইক আটক করে। তখন সরকারদলীয় অনেক নেতাই তৎপর হয়ে ওঠেন সেগুলো থানা থেকে ছাড়াতে। টাঙ্গাইল জেলা পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা জানান, মহাসড়কে আগের তুলনায় অটোরিকশা চলাচল অনেকটাই কমে গেছে। সে কারণে দুর্ঘটনাও কমেছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের জন্য আমরা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বহুবার বলেছি। এগুলো বন্ধের জন্য অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।

https://www.dailyinqilab.com/article/79912/