১৭ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:১২

সোনার ব্যবসাও খাদে ভরা

সোনার গয়নায় যেমন খাদ মেশানো হয়, তেমনি সোনার ব্যবসায়ও আছে ভেজাল। দেশে সোনা ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়ার বড় অংশই অস্বচ্ছ। ব্যবসায়ীদের কারও কাছেই অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত সোনার বৈধ কাগজপত্র নেই। ঋণপত্র খুলে বিদেশ থেকে বৈধভাবে সোনা আমদানির সুযোগ থাকলেও কেউই তা করেন না। এই মূল্যবান ধাতুর জোগানের বড় উৎস বর্তমানে ব্যাগেজ রুলস ও চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সোনার অলংকার কিংবা বার।

সোনা ক্রয়-বিক্রয়ের বড় বাজার পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকা। সেখানকার ‘পোদ্দার’ ব্যবসায়ীরাই এটি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের কাছ থেকে কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই সোনা কেনেন জুয়েলার্স মালিকেরা। এ ছাড়া হাতে গোনা তিন-চারজন ব্যবসায়ী অল্পবিস্তর হীরা আমদানি করেন। তবে গ্রাহকদের কাছ থেকে কাগজপত্র ছাড়াই পুরোনো হীরা কেনেন ব্যবসায়ীরা।
ফলে যে অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের বিক্রয়কেন্দ্র সিলগালা করা হয়েছে, সেই একই দোষে অনেক জুয়েলার্সই দোষী। এ কারণে বহুল আলোচিত আপন জুয়েলার্সে শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের পর আতঙ্কে আছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী।
কয়েকজন জুয়েলার্স ব্যবসায়ী গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, সোনা ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়ে অস্বচ্ছতা রয়ে গেছে। তবে তাঁরা স্বচ্ছভাবে ব্যবসা করতে চান। কিন্তু বর্তমান নীতিমালায় সোনা আমদানির প্রক্রিয়া জটিল ও ব্যয়বহুল। বহুদিন ধরে সরকারের কাছে বৈধভাবে সোনা বিক্রির ব্যবস্থা করার দাবি করলেও কাজের কাজ হচ্ছে না।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনায় প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে শাফাত আহমেদ। দিলদার আহমেদের অবৈধ সম্পদ খুঁজতে আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি বিক্রয়কেন্দ্রে অভিযান চালায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অভিযানকালে গুলশান ২ নম্বরের সুবাস্তু ইমাম টাওয়ারে আপন জুয়েলার্সের সিলগালা করে দেওয়া বিক্রয়কেন্দ্রের কর্মীরা ১৮৭ কেজি সোনার অলংকারের নথিপত্র দেখাতে পারেননি।
বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে জুয়েলারি দোকানের সবচেয়ে বড় বাজার। গতকাল দুপুরের দিকে গিয়ে দেখা যায়, আপন জুয়েলার্সের দুটি বিক্রয়কেন্দ্র খোলা থাকলেও কোনো ক্রেতা নেই। অন্যান্য দোকানও ক্রেতাশূন্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানালেন, আপন জুয়েলার্সে শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের পর থেকে সবাই আতঙ্কে আছেন। এমনকি ক্রেতাদের আনাগোনাও কমে গেছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি গঙ্গা চরণ মালাকার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণপত্র খুলে কোনো ব্যবসায়ী সোনা আমদানি করেন না। কারণ, প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। দামও বেশি পড়ে। ব্যাগেজ রুলেও সোনা আনলে দাম ৫০০ টাকা বেশি পড়ে। পাশের দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদিত এজেন্টের মাধ্যমে সোনা বিক্রি করে। এমন একটি ব্যবস্থা করার জন্য ২০ বছর ধরে দাবি করছি আমরা।’
গঙ্গা চরণ মালাকার আরও বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা সরকারকে কোটি কোটি টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে আসছি। তাই হঠাৎ করে বললেই হবে না আমাদের ব্যবসা অবৈধ। সমস্যার মূলটা কেউ বুঝে সেটি সমাধানের চেষ্টা করুন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুয়েলার্স ব্যবসায় কিছু সমস্যা আছে। সে জন্য আমরা তাদের নীতি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে তারা সম্মানের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘চোরাচালান ও আইন ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরই তা খতিয়ে দেখতে আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালানো হয়েছে। ঢালাওভাবে কোথাও অভিযান চালানো হচ্ছে না। সে জন্য অন্যদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
জুয়েলার্স সমিতি জানায়, তাদের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৭০০। তার বাইরে হাজার দশেক জুয়েলার্স আছে সারা দেশে। ব্যবসায়ীদের সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স এবং জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে ডিলিং লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করার বিধান আছে। অলংকার বিক্রিতে সরকারকে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দিতে হয়।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, বিদেশ থেকে একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম (৮.৫৭ ভরি) পর্যন্ত সোনার অলংকার বিনা শুল্কে এবং ২৩৪ গ্রাম সোনার বার আনতে পারবে। সোনার বারের ক্ষেত্রে প্রতি ১১.৬৬৪ গ্রামে ৩ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে ব্যবসায়ী পর্যায়ে দুটি পৃথক এইচএস কোডে প্রতি ১১.৬৬৪ গ্রাম (এক ভরি) সোনার জন্য ৩ হাজার টাকা এবং ৪ শতাংশ অগ্রিম ব্যবসায় মূসক (এটিভি) দেওয়ার বিধান রয়েছে। যদিও এভাবে কেউ সোনা আমদানি করেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁতীবাজারে দুই শর বেশি পোদ্দার আছেন। প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার ভরি সোনা কেনাবেচা হয়। যার মূল্য আট কোটি টাকার মতো। এই সোনার একটি অংশের জোগান আসে পুরোনো অলংকার গলিয়ে ও ব্যাগেজ রুলসের অধীনে। তবে বড় অংশই আসে অবৈধ পথে।
পোদ্দার সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান আজাদ বলেন, ‘আমরা যাদের কাছ থেকে সোনা কিনে থাকি, তারা কোনো কাগজপত্র দেন না। তাই আমরা যাদের কাছে বিক্রি করি, তাদেরও দিতে পারি না। তাঁর দাবি, চোরাচালানের সোনা তাঁতীবাজারে আসে না।
অন্যদিকে চোরাচালানে আসা সোনার অধিকাংশই ভারতে চলে যায় বলে দাবি করলেন জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি এনামুল হক খান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের মধ্যে সোনার চাহিদা সবচেয়ে বেশি ভারতে। সে জন্য চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে যে সোনা আসে, তা দিয়েই আমাদের চাহিদা মিটে যায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রায় ১১৫ মণ সোনা জমা আছে। এর অর্ধেকেরই মালিকানা কেউ দাবি করেনি। বাকি কিছু অংশের মালিকানা নিয়ে মামলা চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ ২০০৮ সালে নিলামের মাধ্যমে আটক করা সোনা বিক্রি করেছিল।
জানা গেছে, সোনা আটকের পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে তা বুঝে নিতে বলে। নিরাপত্তার জন্য একই চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় পুলিশ কমিশনারকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী একজন স্বর্ণকারের উপস্থিতিতে তা জমা নেওয়া হয়। প্রথমে সোনা অস্থায়ী খাতে জমা হয়। মালিকানা পাওয়া গেলে মামলা হয়। এতে কাস্টমস জয়ী হলে তা স্থায়ী খাতে যায়। মালিকেরা জয়ী হলে তা ফেরত দেওয়া হয়। যেসব সোনার কোনো মালিকানা পাওয়া যায় না, তা বাজেয়াপ্ত করে স্থায়ী খাতে জমা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘আমরা এসব সোনার শুধুই জিম্মাদার। স্থায়ী খাতের সোনা নিলাম হতে পারে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তৈরি বারগুলো আমরা নিজেরাই কিনে সরকারকে টাকা দিয়ে দিই। বাকিগুলো নিলামে বিক্রি হতে পারে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে সম্প্রতি আটক করা সোনা নিলাম করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়। নিলাম হলে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অবৈধ চালান বন্ধ হতে পারে বলে মনে করে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, ‘চোরাচালান বন্ধের জন্য শিগগিরই আমরা আটক করা সোনার নিলাম করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে বলেছি। এ ছাড়া সোনা আমদানিতে ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে অনুমোদন পান, সেটি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1182861/